ইলিশ মাছের দোপেয়াজা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের এক অভিজাত ও স্বাদে অতুলনীয় পদ। “দোপেয়াজা” শব্দটি ফারসি, যার অর্থ “দুই পেঁয়াজ” – এক পেঁয়াজ মসলার সাথে কষিয়ে, আরেক পেঁয়াজ কাঁচা বা হালকা ভেজে শেষে যোগ করা হয়। ইলিশের কোমল গলদে, পেঁয়াজের মিষ্টি রসাল ভাব আর মসলার সুঘ্রাণ এক সুমধুর সমন্বয় তৈরি করে। চলুন দেখে নিই কিভাবে ঘরেই রান্না করবেন রাজকীয় এই পদ:
পরিবেশনের পরিমাণ: ৩-৪ জন
প্রস্তুতির সময়: ৩০ মিনিট (মাছ ভাজার সময় সহ)
রান্নার সময়: ৩০-৩৫ মিনিট
মোট সময়: ৬০-৬৫ মিনিট
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
মাছ ও মাছ প্রক্রিয়াকরণ:
তাজা ইলিশ মাছ (মাঝারি সাইজের কাটা) – ৬-৮ টুকরা (প্রায় ৮০০ গ্রাম – ১ কেজি)
হলুদের গুঁড়া – ১.৫ চা চামচ (১ চা চামচ মাছ মাখানোর জন্য, ০.৫ চা চামচ রান্নার জন্য)
লবণ – ১.৫ চা চামচ (১ চা চামচ মাছ মাখানোর জন্য, ০.৫ চা চামচ রান্নার জন্য)
লেবুর রস – ১ টেবিল চামচ (মাছ ধোয়া ও মাখানোর জন্য)
ঘন দই – ২ টেবিল চামচ (বেটে নেওয়া, ঐচ্ছিক – কিন্তু টক-মিষ্টি ভাব বাড়ায়)
ময়দা বা চালের গুঁড়া – ১-২ টেবিল চামচ (মাছ ভাজার জন্য)
ভাজার জন্য তেল – পর্যাপ্ত (সরিষার তেল বা সয়াবিন তেল)
পেঁয়াজ (দুই ধাপে):
পেঁয়াজ কুচি (মসলার জন্য) – ১.৫ কাপ (৩-৪ টি মাঝারি পেঁয়াজ, ভালো করে কুচি করে কাটা)
পেঁয়াজ রিং/বড় ফালি (দোপেয়াজা গার্নিশের জন্য) – ১ কাপ (২ টি বড় পেঁয়াজ, পাতলা রিং বা হালকা চেরা ফালি করে কাটা)
কাঁচা মরিচ – ৪-৫ টি (লম্বালম্বি ফালি করা, ঝাল কমাতে চাইলে কম দিন)
ধনিয়া পাতা – ৩ টেবিল চামচ (কুচি করা, সাজানোর জন্য)
মসলা (বাটা):
রসুন – ৬-৭ কোয়া
আদা – ১.৫ ইঞ্চি টুকরা
কাঁচা মরিচ – ২-৩ টি (ঐচ্ছিক, বাড়তি ঝালের জন্য)
পানি – অল্প (বাটতে সাহায্যের জন্য)
মসলা (গুঁড়া):
হলুদের গুঁড়া – ০.৫ চা চামচ (রান্নার জন্য)
মরিচের গুঁড়া – ১ চা চামচ (স্বাদ অনুযায়ী কমবেশি)
ধনিয়ার গুঁড়া – ১.৫ চা চামচ
জিরার গুঁড়া – ১ চা চামচ
গরম মসলার গুঁড়া – ১ চা চামচ
জায়ফল গুঁড়া – ১/৪ চা চামচ (ঐচ্ছিক, কিন্তু স্বাদ বাড়ায়)
দারচিনি গুঁড়া – ১/৪ চা চামচ (ঐচ্ছিক)
চিনি – ১ চা চামচ (পেঁয়াজের মিষ্টি বাড়াতে)
লবণ – স্বাদ অনুসারে (মাছ মাখানোর লবণ বাদে)
তরল ও অন্যান্য:
সরিষার তেল – ৫-৬ টেবিল চামচ (রান্নার জন্য, ইলিশের স্বাদে মেলে)
ঘি – ১ টেবিল চামচ (সবশেষে, ঐচ্ছিক কিন্তু জরুরি স্বাদের জন্য)
গরম পানি – ১/২ – ৩/৪ কাপ (প্রয়োজন অনুসারে)
তেজপাতা – ২ টি
দারচিনি – ১ টুকরা (১ ইঞ্চি)
লবঙ্গ – ৪-৫ টি
এলাচ – ৩-৪ টি (হালকা চাপা দিয়ে ফাটানো)
শুকনা মরিচ – ১-২ টি (ভাঙ্গা)
প্রস্তুতি (Preparation):
১. ইলিশ মাছ প্রস্তুত:
* ইলিশের টুকরোগুলো খুব ভালোভাবে (কিন্তু সাবধানে) পানিতে ধুয়ে নিন। লেবুর রস ও ১ চা চামচ লবণ পানিতে মিশিয়ে ১০ মিনিট ভিজিয়ে রাখলে গন্ধ কমে। আবার ধুয়ে নিন।
* একটি বাটিতে মাছ, ১ চা চামচ হলুদের গুঁড়া, ১ চা চামচ লবণ ও ১ টেবিল চামচ ময়দা/চালের গুঁড়া মাখিয়ে নিন। ১৫-২০ মিনিট রেখে দিন।
* একটি কড়াইতে ভাজার জন্য পর্যাপ্ত তেল গরম করুন (মাঝারি আঁচে)। তেল গরম হলে (এক টুকরা পেঁয়াজ দিলে ফুটফুট করে ভাসলে) মাছগুলো সোনালি-বাদামি হয়ে ভেজে উঠা পর্যন্ত ভেজে নিন (প্রতি পাশে ২-৩ মিনিট)। অতিরিক্ত তেল শুষে নেওয়ার জন্য টিস্যু পেপারে রাখুন। খুব সাবধান! ইলিশ ভাজতে বেশি সময় দেবেন না, নরম থাকবে। ভাজা মাছ রেখে দিন।
২. পেঁয়াজ প্রস্তুত:
* ৩-৪ টি পেঁয়াজ খুব ভালো করে ধুয়ে, খোসা ছাড়িয়ে মিহি কুচি করুন (এটি মসলার সাথে কষানো হবে)।
* ২ টি বড় পেঁয়াজ ধুয়ে, খোসা ছাড়িয়ে পাতলা রিং বা হালকা চেরা ফালি করে কাটুন (এটি দোপেয়াজার জন্য শেষে যোগ করা হবে)।
৩. মসলা বাটা: বাটিতে রসুন, আদা ও কাঁচা মরিচ (ঐচ্ছিক) দিয়ে অল্প পানি সহযোগে মিহি পেস্ট করে বেটে নিন।
৪. মসলা মিশ্রণ: একটি ছোট পাত্রে ০.৫ চা চামচ হলুদের গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া, ধনিয়ার গুঁড়া, জিরার গুঁড়া, গরম মসলার গুঁড়া, জায়ফল গুঁড়া (ঐচ্ছিক), দারচিনি গুঁড়া (ঐচ্ছিক) ও চিনি একসাথে মিশিয়ে রাখুন।
৫. দই: দইটি ভালো করে ফেটে নিন (ঐচ্ছিক)।
রান্নার পদ্ধতি (Cooking Method):
১. তেল গরম ও গোটা মসলা ফোড়ন:
* একটি ভারী তলার কড়াই বা হাঁড়িতে ৫-৬ টেবিল চামচ সরিষার তেল গরম করুন।
* তেল গরম হলে মাঝারি আঁচে কমিয়ে দিন। তেজপাতা, দারচিনি, লবঙ্গ, এলাচ ও ভাঙ্গা শুকনা মরিচ দিন। ৩০ সেকেন্ড নেড়ে ঘ্রাণ বের হওয়া পর্যন্ত ভাজুন।
২. কুচি পেঁয়াজ ভাজা (প্রথম পেঁয়াজ):
* মিহি কুচি করা পেঁয়াজগুলো (১.৫ কাপ) ঢেলে দিন। মাঝারি আঁচে ভাজতে শুরু করুন।
* পেঁয়াজ নরম ও স্বচ্ছ হয়ে এলে (প্রায় ৫-৭ মিনিট) ১/২ চা চামচ লবণ দিন (বাকি পরে দেবেন)। এতে পেঁয়াজের রস বের হবে ও ভাজতে সুবিধা হবে।
* ধৈর্য ধরে ভাজতে থাকুন যতক্ষণ না পেঁয়াজ গোলাপি-সোনালি বর্ণ ধারণ করে (প্রায় ১০-১২ মিনিট)। পেঁয়াজ যেন পুড়ে না যায়, শুধু ক্যারামেলাইজড হয়।
৩. বাটা মসলা ভাজা:
* বাটা আদা-রসুন-মরিচের পেস্ট ঢেলে দিন। ভালো করে নেড়ে মিশিয়ে নিন। মাঝারি আঁচে ভাজতে থাকুন যতক্ষণ না তেল আলাদা হয়ে আসে এবং কাঁচা গন্ধ চলে যায় (প্রায় ৪-৫ মিনিট)। পানি শুকিয়ে এলে সামান্য পানি ছিটিয়ে দিতে পারেন।
৪. গুঁড়া মসলা ভাজা ও দই যোগ:
* প্রস্তুত করা গুঁড়া মসলার মিশ্রণটি ঢেলে দিন। দ্রুত নেড়ে ১-২ মিনিট ভাজুন। মসলা পুড়ে গন্ধ না হয় সতর্ক থাকুন।
* এবার বেটে নেওয়া ঘন দইটি (ঐচ্ছিক) ঢেলে দিন (যদি দই দেন)। ভালো করে নেড়ে ২-৩ মিনিট ভাজুন যতক্ষণ না তেল ফের আলাদা হয়ে আসে।
৫. পানি দেওয়া ও ঝোল তৈরি:
* গরম পানি (১/২ – ৩/৪ কাপ, ঝোলের পরিমাণ অনুযায়ী) ঢালুন। ভালো করে নেড়ে মিশ্রণটি ফুটতে দিন।
* স্বাদ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় লবণ দিন (মনে রাখুন মাছে ও পেঁয়াজে কিছু লবণ দিয়েছেন)। ঢাকনা দিয়ে ঢেকে ৪-৫ মিনিট মাঝারি আঁচে ফুটতে দিন যাতে মসলার রং ও স্বাদ পানি/ঝোলে মিশে যায়।
৬. ভাজা ইলিশ ও রিং পেঁয়াজ যোগ (দ্বিতীয় পেঁয়াজ):
* কড়াইয়ে ভাজা ইলিশের টুকরোগুলো সাবধানে একটু একটু করে ছড়িয়ে দিন।
* কাঁচা মরিচের ফালি এবং রিং/ফালি করা কাঁচা পেঁয়াজের প্রায় পুরোটাই (১ কাপ) ছড়িয়ে দিন। খুব সাবধান! মাছগুলো এখন নাড়াচাড়া করবেন না। নাড়লে ভেঙে যাবে। শুধু হালকা করে কড়াইটি ঝাঁকিয়ে দিতে পারেন।
* ফালি করা পেঁয়াজের কিছু অংশ (২-৩ টেবিল চামচ) গার্নিশের জন্য আলাদা করে রেখে দিন।
৭. দোপেয়াজা টানা ও সিদ্ধ করা:
* ঢাকনা ঢেকে দিন। আঁচ একেবারে কমিয়ে দিন (অল্প আঁচে)। মাছগুলো গরম ঝোলে ধীরে ধীরে সেদ্ধ হতে দিন এবং কাঁচা পেঁয়াজগুলো হালকা নরম হয়ে আসবে (প্রায় ৮-১০ মিনিট)।
* দ্রষ্টব্য: ইলিশ খুবই নাজুক মাছ, বেশি সময় দিলে বা জোরে ফুটালে ভেঙে যাবে। আলতোভাবে কড়াই ঝাঁকালেই যথেষ্ট। ঝোল একটু ঘন হওয়া উচিত, খুব রসালো না।
৮. শেষ টাচ:
* আঁচ বন্ধ করে দিন। কুচি করা ধনিয়া পাতা ও বাকি কাঁচা পেঁয়াজ রিং (যা রেখেছিলেন) ছড়িয়ে দিন।
* ১ টেবিল চামচ ঘি ঢেলে দিন (এটা দোপেয়াজার স্বাদকে পূর্ণতা দেয়)। ঢাকনা দিয়ে ৫ মিনিট ঢেকে রাখুন।
৯. পরিবেশন: গরম গরম ভাত, পোলাও, গরম পরোটা বা লাচ্ছা পরোটার সাথে এই রাজসিক ইলিশ মাছের দোপেয়াজা পরিবেশন করুন।
গুরুত্বপূর্ণ টিপস (Important Tips):
ইলিশের মান: তাজা, চর্বিযুক্ত (ফ্যাটি) ইলিশ দোপেয়াজার জন্য আদর্শ। মাছের চোখ উজ্জ্বল, গায়ে চকচকে আঁশ থাকা চাই।
পেঁয়াজের গুরুত্ব: “দোপেয়াজা”-র সৌন্দর্য দুটি পেঁয়াজের টেক্সচার ও স্বাদে। প্রথম পেঁয়াজ (কুচি) গভীর স্বাদ দেয়, দ্বিতীয় পেঁয়াজ (রিং/ফালি) টেক্সচার ও সতেজতা দেয়।
ভাজার কৌশল: ইলিশ খুব কম সময়ে (প্রতি পাশ ২-৩ মিনিট) সোনালি করে ভাজুন। ভেতরে নরম থাকবে। বেশি ভাজলে শুকনো ও শক্ত হয়ে যাবে।
নাড়াচাড়া: মসলার ঝোলে মাছ দেওয়ার পর থেকে কখনই চামচ দিয়ে নাড়বেন না! শুধু কড়াইটি আলতোভাবে ঝাঁকালেই মিশ্রণ সমান হবে। মাছ ভেঙে গেলে সৌন্দর্য নষ্ট হয়।
আঁচের নিয়ন্ত্রণ: মসলা কষানোর সময় মাঝারি আঁচ, কিন্তু মাছ দেওয়ার পর একেবারে কম আঁচে (সিমমার) রান্না করতে হবে। জোরে ফুটালে মাছ ভেঙে যাবে।
ঝোলের পরিমাণ: দোপেয়াজায় ঝোল খুব বেশি হয় না। মাছ ডোবানোর মতোই পানি দিন। শেষে একটু ঘন ঝোলই কাম্য। প্রয়োজনে ঢাকনা খুলে কিছুক্ষণ আঁচে রেখে পানি শুকিয়ে নিন।
দই: দই দিলে ঝোলে একটু ক্রিমিনেস ও টক-মিষ্টি ব্যালেন্স আসে। কিন্তু না দিলেও চলে।
ঘি: শেষে ঘি দেওয়া দোপেয়াজার ঐতিহ্যবাহী স্বাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাদ দেওয়া উচিত নয়।
লেবুর রস: ইলিশ ধোয়ার সময় লেবুর রস ব্যবহার করলে মাছের গন্ধ অনেকটাই চলে যায়।
গরম মসলা: জায়ফল ও দারচিনি গুঁড়া স্বাদে গভীরতা আনে, তবে এগুলো ঐচ্ছিক।
মৌসুম: বর্ষা ও শরতের ইলিশ সবচেয়ে সুস্বাদু হয় দোপেয়াজার জন্য।
রাজকীয় এই ইলিশ মাছের দোপেয়াজা পরিবেশন করে পরিবার ও অতিথিদের মুগ্ধ করুন। রান্না করুন, স্বাদ নিন! 😊