এই রেসিপিটি বাংলাদেশের ঘরে ঘরে জনপ্রিয় এক কমফোর্ট ফুড। ছোট ছোট গোল আলু আর টমেটোর মিষ্টি টক রসে সেদ্ধ নরম শিং মাছের স্বাদ এক কথায় অতুলনীয়! চলুন দেখে নেওয়া যাক কিভাবে সহজেই তৈরি করবেন এই মুখরোচক পদটি:
পরিবেশনের পরিমাণ: ৩-৪ জন
প্রস্তুতির সময়: ২০ মিনিট
রান্নার সময়: ৩০-৩৫ মিনিট
মোট সময়: ৫০-৫৫ মিনিট
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
মাছ ও মাছ প্রক্রিয়াকরণ:
শিং মাছ – ৫০০ গ্রাম (মাঝারি সাইজের, তাজা)
হলুদের গুঁড়া – ১ চা চামচ
লবণ – ১ চা চামচ (মাছ মাখানোর জন্য)
সবজি:
ছোট গোল আলু – ১৫-২০ টি (মোটামুটি সমান সাইজের, চিকন করে ধুয়ে খোসা ছাড়ানো)
পাকা টমেটো – ৩ টি মাঝারি সাইজের (কুচি করে কাটা)
কাঁচা মরিচ – ৫-৬ টি (লম্বালম্বি ফালি করা, ঝাল কমাতে চাইলে কম দিন)
ধনিয়া পাতা – ২ টেবিল চামচ (কুচি করা, সাজানোর জন্য)
মসলা (বাটা):
পেঁয়াজ কুচি – ১/২ কাপ (বা ১ টি মাঝারি পেঁয়াজ)
রসুন – ৫-৬ কোয়া
আদা – ১ ইঞ্চি টুকরা
কাঁচা মরিচ – ২-৩ টি (ঐচ্ছিক, বাড়তি ঝালের জন্য)
পানি – অল্প একটু (বাটতে সাহায্যের জন্য)
মসলা (গুঁড়া):
হলুদের গুঁড়া – ১ চা চামচ
মরিচের গুঁড়া – ১ চা চামচ (স্বাদ অনুযায়ী কমবেশি)
ধনিয়ার গুঁড়া – ১ চা চামচ
জিরার গুঁড়া – ১/২ চা চামচ
গরম মসলার গুঁড়া – ১/২ চা চামচ (ঐচ্ছিক, তবে দিলে স্বাদ ভালো হয়)
চিনি – ১ চা চামচ (স্বাদ সংযোজনের জন্য, ঐচ্ছিক)
লবণ – স্বাদ অনুসারে (মাছ মাখানোর লবণ বাদে)
ফোড়নের জন্য:
সরিষার তেল – ৪-৫ টেবিল চামচ (বেশি দিলে স্বাদ ভালো হয়)
পাঁচ ফোড়ন (মৌরি, সর্ষে, মেথি, কালোজিরা, জিরা) – ১/২ চা চামচ (ঐচ্ছিক, নাইলে শুধু সর্ষে+মেথি+জিরা)
শুকনা মরিচ – ১-২ টি (ভাঙ্গা)
তেজপাতা – ১ টি (ঐচ্ছিক)
অন্যান্য:
গরম পানি – ২-২.৫ কাপ (মাছ ও আলু ডোবানোর মতো)
ঘি – ১ চা চামচ (সবশেষে, ঐচ্ছিক – কিন্তু স্বাদ বাড়ায়)
প্রস্তুতি (Preparation):
১. মাছ প্রস্তুত: শিং মাছগুলো ভালোভাবে ধুয়ে নিন। একটি বাটিতে মাছ, ১ চা চামচ হলুদের গুঁড়া ও ১ চা চামচ লবণ মেখে কমপক্ষে ১৫-২০ মিনিট রেখে দিন।
২. আলু প্রস্তুত: ছোট গোল আলুগুলো ভালো করে ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে নিন। যদি একটু বড় হয়, অর্ধেক করে কেটে নিন যাতে সেদ্ধ হতে সুবিধা হয়।
৩. টমেটো কুচি: টমেটোগুলো ছোট কিউব করে কুচি করে নিন।
৪. কাঁচা মরিচ ফালি: কাঁচা মরিচগুলো লম্বালম্বি ফালি করে কেটে নিন।
৫. মসলা বাটা: বাটিতে পেঁয়াজ কুচি, রসুন কোয়া, আদা টুকরা ও কাঁচা মরিচ (ঐচ্ছিক) দিয়ে অল্প পানি সহযোগে পেস্ট করে বেটে নিন। খুব মিহি না করে একটু কাঁচা কাঁচা ভাব থাকলেও চলে।
৬. মসলা মিশ্রণ: একটি ছোট পাত্রে হলুদের গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া, ধনিয়ার গুঁড়া, জিরার গুঁড়া, গরম মসলার গুঁড়া ও চিনি (ঐচ্ছিক) একসাথে মিশিয়ে রাখুন। এতে রান্নার সময় আলাদা আলাদা মসলা দিতে হবে না।
রান্নার পদ্ধতি (Cooking Method):
১. তেল গরম ও ফোড়ন: একটি কড়াই বা হাঁড়িতে (প্রেশার কুকার ছাড়া) তেল গরম করুন। তেল গরম হলে আঁচ মাঝারি করে কমিয়ে দিন। তেজপাতা (ঐচ্ছিক), শুকনা মরিচ ও পাঁচ ফোড়ন (বা সর্ষে+মেথি+জিরা) দিন। ফোড়ন ফেটে টপটপ শব্দ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন (১০-১৫ সেকেন্ড)।
২. বাটা মসলা ভাজা: ফোড়নে বাটা মসলা (পেঁয়াজ-রসুন-আদা-মরিচের পেস্ট) ঢেলে দিন। ভালো করে নাড়ুন। মাঝারি আঁচে ভাজতে থাকুন যতক্ষণ না তেল আলাদা হয়ে আসে এবং মসলার কাঁচা গন্ধ চলে যায় (প্রায় ৫-৭ মিনিট)। পানি শুকিয়ে এলে সামান্য পানি ছিটিয়ে দিতে পারেন।
৩. গুঁড়া মসলা ভাজা: এবার প্রস্তুত করা গুঁড়া মসলার মিশ্রণটি (হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, জিরা, গরম মসলা, চিনি) ঢেলে দিন। দ্রুত নাড়াচাড়া করে ১ মিনিটের মতো ভাজুন। খেয়াল রাখুন মসলা যেন পুড়ে না যায়।
৪. টমেটো ভাজা: কুচি করা টমেটোগুলো ঢেলে দিন। ১/২ চা চামচ লবণ দিন (বাকি লবণ পরে দেবেন)। মাঝারি আঁচে ভাজুন যতক্ষণ না টমেটো নরম হয়ে যায় এবং তেলের উপর ভাসতে শুরু করে (প্রায় ৪-৫ মিনিট)। চামচ দিয়ে টমেটোগুলো একটু চটকে দিলে রস বের হবে।
৫. আলু ভাজা ও সিদ্ধ: আলুগুলো ঢেলে দিন। ভালো করে নাড়ুন যাতে সব আলু মসলার সাথে মিশে যায়। ২-৩ মিনিট আলু ভাজুন। এবার গরম পানি ঢালুন (আলু ও মাছ ডোবানোর মতো, প্রায় ২-২.৫ কাপ)। স্বাদ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় লবণ দিন (মনে রাখবেন আগে কিছু লবণ দিয়েছেন)। আঁচ বাড়িয়ে মিশ্রণটি ফুটতে দিন। ঢাকনা দিয়ে ঢেকে মাঝারি আঁচে আলু প্রায় সেদ্ধ হওয়া পর্যন্ত রান্না করুন (প্রায় ১০-১২ মিনিট)। আলুতে কাঁটা ফুটালে সহজে ভেদ হয়ে গেলে বুঝবেন সেদ্ধ হয়েছে।
৬. মাছ দেওয়া: এবার লবণ-হলুদ মাখানো শিং মাছগুলো একটু একটু করে সাবধানে কড়াইয়ে ছড়িয়ে দিন। ফালি করা কাঁচা মরিচগুলোও দিয়ে দিন। খুব সাবধান! মাছগুলো এখন নাড়াচাড়া করবেন না। নাড়লে ভেঙে যাবে।
৭. ঝোল টানা: ঢাকনা ঢেকে দিন। আঁচ মাঝারি থেকে একটু কম রাখুন। মাছগুলো সেদ্ধ হওয়া পর্যন্ত রান্না করুন (প্রায় ৭-৮ মিনিট)। মাঝে একবার হালকা করে হাঁড়িটা ঝাঁকিয়ে দিতে পারেন, চামচ দিয়ে নাড়বেন না। মাছ সেদ্ধ হয়ে গেলে দেখবেন ঝোল একটু ঘন হয়ে গেছে এবং তেলের আভা ভেসে উঠেছে। দ্রষ্টব্য: শিং মাছ খুব দ্রুত সেদ্ধ হয়, তাই বেশি সময় দেবেন না, নইলে মাছ শক্ত হয়ে যাবে।
৮. শেষ টাচ: আঁচ বন্ধ করে দিন। কুচি করা ধনিয়া পাতা ছড়িয়ে দিন। চাইলে ১ চা চামচ ঘি ঢেলে দিলে স্বাদ ও ঘ্রাণ দুটোই বেড়ে যাবে (অত্যন্ত Recommended!)। ঢাকনা দিয়ে ২-৩ মিনিট ঢেকে রাখুন।
৯. পরিবেশন: গরম গরম ভাত, গরম ভাতের ভাপ, পোলাও বা নরম খিচুড়ির সাথে পরিবেশন করুন এই অতুলনীয় স্বাদের শিং মাছের ঝোল।
গুরুত্বপূর্ণ টিপস (Important Tips):
মাছের ফ্রেশনেস: তাজা শিং মাছ ব্যবহার করাই সবচেয়ে ভালো। মাছের গায়ে উজ্জ্বল রং এবং টানটান গায়ের চামড়া দেখে নিন।
আলুর সাইজ: ছোট গোল আলুই এই রেসিপির সৌন্দর্য। এগুলো ঝোলে পুরোপুরি সেদ্ধ হয় এবং রস শুষে নেয়। বড় আলু কেটে ছোট করতে হবে।
তেল: সরিষার তেল দিলে ঝোলে অথেন্টিক স্বাদ আসে। তবে সূর্যমুখীর তেলও ব্যবহার করা যায়।
ঝাল নিয়ন্ত্রণ: ঝালের মাত্রা মরিচের গুঁড়া এবং কাঁচা মরিচ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করুন। চাইলে মরিচের গুঁড়া কম দিন।
মাছ না নাড়া: মাছ দেওয়ার পর থেকে পরিবেশন পর্যন্ত মাছগুলো চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া করা একদম নিষেধ! এতে মাছ ভেঙে যাবে এবং ঝোল ঘোলাটে হয়ে যাবে। হাঁড়ি ঝাঁকানোর মাধ্যমেই সামলাতে হবে।
ঝোলের ঘনত্ব: প্রাথমিকভাবে আলাদা করে পানি কম দিন। পরে প্রয়োজনে আরও অল্প গরম পানি যোগ করা যায়। ঝোল একটু ঘন হলে স্বাদ ভালো লাগে।
চিনি: টমেটোর টকভাব ব্যালেন্স করার জন্য অল্প চিনি দেওয়া হয়। টমেটো খুব টক না হলে বাদও দিতে পারেন।
পাঁচ ফোড়ন: পাঁচ ফোড়ন না থাকলে শুধু ১/৪ চা চামচ সর্ষে + ১/৪ চা চামচ মেথি + ১/৪ চা চামচ জিরা দিয়েও কাজ চলে যাবে।
সবশেষে ঘি: ঘি দেওয়াটা ঐচ্ছিক, কিন্তু এই ছোট্ট টাচ ঝোলের স্বাদকে একদম অন্য লেভেলে নিয়ে যায়।
আরামদায়ক ভাতের সাথে গরম গরম এই শিং মাছের ঝোল পরিবেশন করুন। আপনার রান্না অবশ্যই সুস্বাদু হবে! রান্না করুন, খুশি থাকুন। 😊