লাউ বর্তমানে একটি জনপ্রিয় সবজি হিসাবে সকলের কাছে পরিচিত। সবজি জগতের অন্যতম একটি সবজির নাম হচ্ছে লাউ। অনেক আগে থেকেই এটি চাষাবাদ হয়ে আসছে। বর্তমানে এর জনপ্রিয়তা বহুগুন বেড়েছে। সুধু এর কচি ফলই নয়, কচি ডগাও শাক হিসেবে খাওয়া হয়। এর অনেক পুষ্টিগুনও আছে। এতে ক্যালশিয়াম ও ফসফরাস থাকায় দাত ও হাড়ের গঠন মজবুত রাখে। ক্যালোরির পরিমান কম থাকায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী। এছাড়াও পেটের বহু পীড়া উপসম করে। বর্তমানে আধুনিক উপায়ে আগাম লাউ চাষ পদ্ধতি এর মাধ্যেমে ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে ও কৃষক লাভবান হচ্ছে।
লাউ চাষাবাদ করার জন্য যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে
লাউ চাষাবাদ শুরু করার পূর্বে আপনাকে কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। সেগুলো নিচে দেয়া হলো।
লাও চাষ সম্পর্কে আপনার কতটুকু ধারনা বা জ্ঞান আছে?
আপনার এলাকায় কি লাও চাষে অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তি আছে, যে আপনাকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারে?
আপনার এলাকায় লাও এর চাহিদা কেমন? গোল লাও ভালো চলে নাকি লম্বা লাও? নাকি দুটোই?
আপনার এলাকার আবহাওয়া কি লাও চাষের উপযুক্ত?
আপনার জন্য লাও চাষে সুযোগ-সুবিধা কতটুকু?
লাও চাষ কি ঝামেলা মনে হয়, নাকি পছন্দ করেন? এর প্রতি কি আপনার আবেগ আছে?
লাও চাষ করে কি লাভবান হতে পারবেন?
বাজার ব্যবস্থা কেমন? প্রশ্নগুলোর উত্তর পজিটিভ হলে এগিয়ে যেতে পারেন।
মাটির ধরণ
এটেল-দোআঁশ, দোআশ, বেলে-দোআশ ইত্যাদি সব ধরনের মাটিতেই লাও চাষ করা যায়। তবে এটেল মাটি যেহেতু পানি ধরে রাখায় ওস্তাদ, তাই খরা মৌসুমে এটেল মাটি লাও চাষের জন্য পার্ফেক্ট। কারন “Bottle gourd is very hungry and thirsty plant” অর্থাৎ এটি খুব তৃষ্ণার্ত ও খুদার্ত উদ্ভিদ। তবে জমি উচুতে হতে হবে, যাতে গোড়ায় পানি না জমে।
লাউ চাষের সময়
লাউ শীতকালীন সবজি হলেও এখন সারা বছর চাষাবাদ করা সম্ভব হচ্ছে। আগাম শীতকালীন বা শীতকালে চাষাবাদের জন্য ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক মাসে বীজ বপন করতে হয়। আর গ্রীষ্মকালে চাষাবাদের জন্য মাঘ-ফাল্গুনে বীজ বপন করতে হবে। এছাড়াও বছরের যে কোন সময় চাষাবাদ করা সম্ভব। তবে অতিরিক্ত বর্ষায় ফলন কমে যায়।
লাউয়ের জাত নির্বাচন
গ্রীষ্মকালীন চাষাবাদের জন্য লাল তীর কোম্পানির ডায়না, বারি লাও -৪ সহ আরো বহু কোম্পানীর হাইব্রিড জাত পাওয়া যায়। মেটাল সিড কোম্পানির “হাই গ্রিন, নাইস গ্রিন”, এসি আই এর ” ময়না, রওনক, মার্শাল সুপার”, সুপ্রিম সিড এর “গ্রিন ম্যাজিক” ইস্পাহানীর “সুলতান, নবাব, সম্রাট, বাদশাহ”, এছাড়াও ইন্ডিয়ান লাও সহ অন্যান্য বহু কোম্পানির হাইব্রিড লাও গ্রীষ্মকালে চাষাবাদ করা যায়। শীতকালের জন্য দেশি লাও সহ যে কোন লাও চাষ করা যায়। তবে বানিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করতে হলে অবশ্যই উপরোক্ত হাইব্রিড জাতের লাও চাষ করতে হবে। এ সময় হাইব্রিড জাতের হাজারী লাও ভালো ফলন দেয় এমন শোনা যায়।
লাউয়ের চারা তৈরী
বীজ সরাসরি জমিতে বপন করা যায়, আবার চারা তৈরী করেও রোপন করা যায়। চারা তৈরী করে রোপনে নিরাপত্তা, সময় কম ও ফলন বেশি হয়। প্রথমে বীজ ২-১ ঘন্টা রোদ্রে রেখে তা ছায়ায় ঠান্ডা করে নিতে হবে। এর পর ২০-২৫ ঘন্টা পানিতে রেখে দিতে হবে। শেষ ১০ মিনিট ২ গ্রাম/ লিটার পানিতে কার্বেন্ডাজিম দিয়ে শোধন করে নিতে পারেন। এর পর সবচেয়ে ভালো হয় বীজগুলো গরম কাপড়/ ছালার চট ভিজিয়ে তাতে পেচিয়ে ২ দিন অপেক্ষা করা।
দুই দিনে বীজ ফেটে শেকড় বের হলে তা সাবধানে পলিব্যাগে বপন করতে হবে। মাটিতে রস না থাকলে সামান্য একটু পানি দিতে হবে। পলিব্যগে ২ ভাগ এটেল মাটির সাথে ১ ভাগ পচা ঝুরঝুরে গোবর মিক্স করে নিতে হবে। অতিরিক্ত পানি বের হওয়ার জন্য পলি ব্যগের নিচে ফুটো করে নিতে হবে। পলিব্যাগে রোপনের ৩ দিন পর গাছ বের হবে। গাছ বের হওয়ার ১৫-১৭ দিন পর চারা গাছের ৩-৪ টা পাতা আসলে তা রোপনের উপযুক্ত হবে। রোপনের আগ পর্যন্ত গাছগুলো আদা-ছায়ায় রাখতে হবে।
জমি প্রস্তুতকরন
লাউ গাছের শেকড় প্রায় ২ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তাই যাতে সহজে শেকড় অনেক দুর যেতে পারে তার জন্য গভীরভাবে ৩-৪ টা চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। গোবর বা জৈব সার বেশি পরিমানে ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায়। এগুলো চাষের আগে বা মাদাতেও দেয়া যায়। চাষের পর ২.৫ অথবা ৩ মিটার প্রশস্ত বেড তৈরী করতে হবে। ২.৫ মিটার পর পর মাদা করতে হবে।
মাদা তৈরী ও সার প্রয়োগ
২ ফিট ব্যাস আর ১.৫ ফিট গভির করে গর্ত করে মাদা তৈরী করতে হবে। প্রতি মাদায় ২০০ গ্রাম টিএসপি + ১০০ গ্রাম জিপসাম + ৫০ গ্রাম এমওপি + (জিংক, বোরন, ম্যাগনেসিয়াম, কার্বোফুরান ১৫-২০ গ্রাম হারে দেয়া যায়)। আর বেশি বেশি গোবর বা জৈব সার দিলে অতি উত্তম।
চারা রোপন
মাদা প্রতি ২-৩ টি চারা রোপন অথবা ৩-৪ টি বীজ বপন করতে হবে। পরবর্তীতে মাদায় ২-১ টি গাছ রাখলেই চলবে। জমি শুকনো থাকলে চারা রোপন করে পানি দিতে হবে। প্রখর রৌদ্র থাকলে রোপনকৃত চারা কিছু দিয়ে রোদ থেকে আড়াল করে রাখতে হবে।
চারা পরিচর্যা
বিটল পোকা এসে পাতা খেয়ে নিলে ছাই, কেরোসিন+পানি, অথবা সাইপারমেথ্রিন/ক্লোরপাইরিফস হালকা করে স্প্রে করতে হবে অথবা মশারি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। ১৫ দিন পর ২ কেজী ইউরিয়া ও দেড় কেজী এমওপি সার (এই হারে) মিক্স করে প্রতি মাদায় ২-৩ মুঠ করে গোড়া থেকে ৬ ইঞ্চি দুরে গোল করে দিয়ে নিড়ানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। গাছ লতা নিতে শুরু করলে বাশের কঞ্চি বা শক্ত কাঠি দিতে হবে।
লাউ গাছের মাচা তৈরী
লাউ এর গাছ অনেক ভারি হয়, তাই মাচা মজবুত করে দিতে হবে যতে ভারিতে ভেঙে না যায়। চারিদিকে টানা দিয়ে রাখতে হবে।
লাউ গাছের পরিচর্যা
সুধু ভালো জাত আর জমিন নির্বাচনে ফলন নিশ্চিত হয় না। অধিক ফলন পাওয়ার জন্য অধিক পরিচর্যা করতে হয়। লাউ গাছ মাচায় ওঠার সময় গোড়া থেকে অনেক শোষক শাখা বের হয়। গাছের গোড়া থেকে ২.৫ ফিট পর্যন্ত বা মাচায় ওঠার আগে যে শাখাগুলো বের হয়, তা কেটে ফেলতে হবে। গাছ মাচায় উঠে কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পর গাছের মাথা কেটে দিতে হবে। এতে অনেক শাখা বের হবে এবং দ্রুত কড়া আসবে। গাছে ফুল আসলে ফেরমনের ব্যবস্থা করতে হবে। কড়া আসলে নিয়মিত হাত পরাগায়ন করতে হবে। তাহলে প্রচুর পরিমান লাউ এর ফলন হবে। দুর্বল লতাগুলো ছাটাই করতে হবে। গাছে মাচা ভর্তি হয়ে গেলে সম্পূর্ণ মাচার গাছের পাতা কেটে দিয়ে আবার নতুন করে ফলন নেয়া যায়। তবে পাতা কেটে ছত্রাকনাষক স্প্রে করতে হবে।
লাউ গাছে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। তাই খরার সময় ৪-৫ দিন পর পর পানি দিতে হয়। মাটি স্যাতস্যতে অবস্থায় রাখলে খুব ভালো হয়।
সার প্রয়োগ
মনে রাখতে হবে, লাউ গাছ খুবই ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত উদ্ভিদ। তাই একে প্রচুর পরিমান সার দিতে হবে, তাহলে ফলন ভালো হবে। গাছে ফল দেয়া শুরু হলে ২-১ সপ্তাহ পর পর বা গাছের শক্তি কম মনে হলে ডিএপি সার ব্যবহার করতে হবে। তবে এর সাথে সামান্য ইউরিয়া ও পটাশ সমপরিমান দেয়া যায়। মাঝে মাঝে জিংক ও ম্যাগনেসিয়াম সারও খুবই সামান্য পরিমান দিতে হবে। এগুলো গাছের ফল আনয়ন ও বড় করতে সাহায্য করবে। লাউ গাছে প্রচুর ক্যালশিয়ামের প্রয়োজন হয়। তাই মাঝে মাঝে জিপসাম দিতে হবে। ফল ঝরা বন্ধ করার জন্য বোরনও দিতে হবে। গাছে যদি কড়া কম আসে, তাহলে হরমন হিসেবে লিটোসেন বা ফ্লোরা স্প্রে করতে হবে। অনুখাদ্য হিসেবে চিলেটেড জিংক স্প্রে করা যায়। আর যতটুকু সম্ভব জৈব সারের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
পোকামাকড়
ফলের মাছি পোকা অভিপজিটর ঢুকিয়ে কচি লাউ এ কিড়া ছেড়ে দেয়। তাই কচি লাউ মারা যায়। এর জন্য ফেরমন বা সপ্তাহে দুই-এক বার সাইপারমেথ্রিন স্প্রে করতে হবে। লাউ গাছে ক্ষুদ্র শোষক পোকাও দেখা যায়। এরা ভাইরাসের বাহক। তাই সপ্তাহে ২-১ বার ইমিডাক্লোরপ্রিড স্প্রে করতে হবে। এছাড়া ল্যাদা পোকা জাতীয় সবুজ পোকা কচি পাতা কুরে খেয়ে ফেলে বা লাউ এর ত্বক নষ্ট করে। এর জন্য মাঝে মাঝে এমামেকটিন বেনজয়েড স্প্রে করতে হবে।
সাদা মাছি, জাব পোকা, থ্রিপস পোকা ইত্যাদি শোষক পোকার আক্রমনে লাউ গাছে মোজাইক ভাইরাস হতে পারে। গাছের পাতা কিছুটা কুকড়ে যায় ও হলুদ-সবুজ ছোপ ছোপ দেখায়। ফলের রং ও আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়। এ রোগ প্রতিকার সম্ভব নয়, তাই গাছ তুলে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে। বাহক পোকা দমন করার জন্য ইমিডাক্লোরপ্রিড স্প্রে করতে হবে।
রোগ বালাই
লাউ গাছে ডাওনি মিলডিউ বা পাউডারী মিলডিউ রোগ দেখা যায়। পাওডারী মিলডিও রোগে পাতার উপর ক্ষুদ্র সাদা পাওয়ার দেখা যায়। কার্বপন্ডাজিম বা ক্যবরিওটপ অথবা অন্যান্য ছত্রাকনাষক ব্যবহার করে এ রোগ ঠিক করা যায়। ছত্রাকনাষক স্প্রে করলে লাউ এর পচনজনিত রোগও ঠিক হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। লাউ এর রং ও খুব সুন্দর ও আকর্ষনীয় হয়। গাছের শেকড়ে নেমাটোডা বা কৃমির আক্রমনে শেকড়ে গিটের সৃষ্টি হলে গোড়ায় সামান্য কার্বোফুরান দিতে হবে।
ফলন
লাউ কচি অবস্থায় সংগ্রহ করতে হয়। পরাগায়নের ১৫ দিন পরই লাউ খাওয়ার উপযুক্ত হয়। উপযুক্ত হলে সাথে সাথে কেটে মাচা পাতলা করে দিতে হবে। এতে ফলন বৃদ্ধি পাবে।
লেখকঃ মোঃ মহিউদ্দিন অনিক
পোস্টটি সাকসেস ফার্ম বিডি থেকে সংগৃহীত