গড়ে তুলুন দক্ষিণ আফ্রিকার “বয়ার” জাতের ছাগল, ওজন হবে বছরে ৭০ কেজি

ছাগল একটি লাভজনক দ্রুত বর্ধনশীল গৃহ পালিত পশু। আমাদের দেশে ব্লেক বেঙ্গল জাতের ছাগল সারা দেশেই পাওয়া যায়। কিন্তু লাভজনক খামার করতে গেলে দ্রুত বর্ধনশীল বিখ্যাত জাতের ছাগল পালনের কোন বিকল্প নাই। উন্নত জাতের ছাগল পালনে একই সময়ে ৩/৪ গুণ বেশী পরিমান লাভ করা যায়। আমাদের দেশে উন্নত জাতের ছাগল পালন করে অনেকেই তার ভাগ্য বদলে দিয়েছেন। এমনই একটি খামারের পরিচয় করিয়ে দিব।

 

 

যারা নিজস্ব অর্থায়নে উন্নত জাতের খামার করে নিজেদের ভাগ্য বদলাতে চলছে। ইতিমধ্যে শতাধিক উন্নত জাতের বাচ্চা ছাগল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন। একদম নতুন উদ্যোক্তা হলেও বলা যায়, অনেক দক্ষতা তাদের রয়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতের ছাগল পালন করা হচ্ছে  বাসা বাড়িতে বাড়তি আয় এর জন্য ছাগল পালন করা যেতেই পারে।

 

 

তবে বাণিজ্যিক ভাবে ছাগল পালন করতে হলে, জানতে হবে ছাগলের উন্নত জাত সম্পর্কে। এই উন্নত জাতের ছাগল কোথায় পাবেন, কোথায় রাখবেন, তার চিকিৎসা পদ্ধতি কি, এগুলো জানা দরকার। এজন্য আমরা চলে এসেছি, গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার ”অক্টাগণ এগ্রো ফার্মে”।

 

 

রিয়াসাত রিফফাত নবী মলিন, তিনি অক্টাগণ এগ্রো ফার্মের একজন প্রতিষ্ঠাতা। তারা এ ফার্ম ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। পলাশবাড়ী, গাইবান্ধায় এই খামারটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি নিজেই এই খামারটি দেখা শোনা করেন। মাত্র কয়েকটি খাগল দিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে শতাধিক ছাগল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন।

 

 

বয়ার নামে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বিখ্যাত ছাগলের জাত রয়েছে। এই জাতের সাথে দেশীয় জাতের ছাগলের ক্রস এর মাধ্যমে এই জাতের উন্নয়ন করার চেষ্টা চলছে। ১৯০০ সালের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকাতে প্রথমবার বয়ার নামে ছাগলের এই জাতটি দেখা যায়। উন্নত জাতের ছাগলের সাথে এই জাতের প্রজনন ঘটিয়ে তার থেকে আরও উন্নত করা হয়েছে। ফলে এই জাতটি খুব দ্রুতই বেড়ে ওঠে।

 

 

প্রতিদিন গড়ে এ জাতটি ওজন ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত বাড়ে। সে হিসাবে ৬ মাসে একটি ছাগলের ওজন দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৩৫ কেজি পর্যন্ত। সে কারণেই সারা পৃথিবীতে মাংস উৎপাদনের জন্য এই ছাগলটি বেশ জনপ্রিয়। দামের বিবেচনায় এ জাতের ছাগল একটু ব্যয়বহুল।

 

 

তবে স্থানীয় জাতের সাথে ক্রস করালে ৫০ শতাংশ ব্রীডিং চলে আসে। ৫০% ব্রীডিং চলে আসলেই প্রতিটি ছাগল ছয় মাসে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি ওজন হয়ে যায়। বয়ার প্রজাতির ছাগলের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এরা যেকোন পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে চলতে পারে। ফলে পালন প্রক্রিয়াও অত্যন্ত সহজ হয়ে থাকে।

 

 

শুরুটা যেভাবে হয়েছিল, মলিন জানান, তারা বন্ধুরা, যারা একসাথে পড়তেন, তারা সবাই মিলে কিছু করার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় চিন্তা করলেন, একটা ছাগলের খামার দেওয়া যায়। তারপরে ইন্টারনেট, ইউটিউব ও গুগল, এগুলো ঘেঁটে এই জাতটি বাছাই করে, তারা ছাগলের ফার্ম শুরু করেন।

 

 

মলিন মনে করেন, তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন, যদিও তাদের অনেক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়েছে। যেহেতু ব্রীডিং খামার করেছেন, সেতো ধৈর্য ধরতেই হবে। তারা শুরুতে ২৬ টি ছাগল দিয়ে খামার শুরু করেছিলেন। ২৬ টি ছাগল থেকে ১১৫ টি ছাগল ব্রীডিং করতে পেরেছেন।

 

 

এথেকে কিছু ছাগল এই পর্যন্ত বিক্রিও করা হয়েছে। ছাগল কমার্শিয়ালি পালন করতে গেলে, ছাগলের আলো-বাতাস সুবিধাসহ পর্যাপ্ত সুন্দর একটি বাসস্থান প্রয়োজন। পানি যেন জমে না থাকে, ছাগলের ঘরটি এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে, যেন পর্যাপ্ত আলো বাতাস ঢুকতে পারে এবং বাতাসের সাথে যেন ভিতরে জমে থাকা গ্যাস গুলো বের হয়ে যেতে পারে।

 

 

ছাগলের ঘরগুলো ভেন্টিলেশন করে, এমনভাবে করা হয়েছে, যেখান থেকে বাতাসের চেয়ে হালকা গ্যাস গুলো উপর দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও কিছু গ্যাস আছে একটু ভারী, সেগুলোও বাতাসের চাপের সাইট দিয়ে বের হয়ে যাবে, এজন্য চারদিকে খোলা রাখতে হয়।

 

 

ছাগলের খামারে জন্য ছাগলের জাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তারা বয়ার জাতটি নির্বাচন করেছেন। এই জাতটি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের যেকোনো জায়গায় থাকতে পারে। এ জাতের সাথে দেশী জাতের ছাগলের ক্রস করে অনেকগুলো বাচ্চাও হয়েছে। বাচ্চাগুলো এখন অনেক বড় বড় ছাগল হয়েছে।

 

 

মলিন জানান, তার খামারটি ১০০ ফুট বাই ২৫ ফুট, মাঝখানে হাঁটার জন্য পাঁচ ফুট রাস্তার জায়গা ছেড়ে দিয়েছি। ছাগলদের সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। রোগের শুরুতে চিকিৎসা করতে হবে। সব সময় শুকনা পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।

 

 

ছাগলের ঘর গুলোকে ছোট ছোট করে ভাগ করে নিতে হবে। কোনটার মধ্যে থাকবে গর্ভবতী ছাগল, কোনটার মধ্যে খাসি, কোনটায় থাকবে পাঠা, কোন ঘরে থাকবে ছোট ছোট বাচ্চা। ছাগল পালনের জন্য বাচ্চা সংগ্রহের সময়টা খুব জরুরী না।

 

 

তবে অতিরিক্ত গরম, অতিরিক্ত ঠান্ডা এবং অতিরিক্ত বৃষ্টি, এগুলো ছাগল সহ্য করতে পারে না। ছাগলগুলো খামারে সাধারনত যে সময় বৃষ্টি থাকবে না, বেশী গরম থাকবে না বা বেশি ঠান্ডা থাকবে না, এমন শুকনো সময়ে ছাগলগুলো কিনে এনে খামারে রাখতে হয়। খামারের ভিতরে ছাগল রাখার জন্য একটা প্লাস্টিকের মেট দিয়ে পাটাতন বা চৌকি বানিয়ে রাখা হয়েছে।

 

 

এটি মাটি থেকে তিন ফুট উপরে রয়েছে। খামারের ভিতরে ১০০ স্কয়ার ফুটে দশটি ছাগল রাখা সম্ভব। এই খামারে তিনটি বড় বড় বয়ার পাঠা রয়েছে। এগুলো শুধু ব্রীডিং এর জন্যই ব্যবহার করা হয়। এক একটি পাঁঠার ওজন ১২০ কেজি করে। এ খামারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্রীডিং এর মাধ্যমে সমস্ত ছাগলগুলোকে বয়ারে রূপান্তর করা। সেটা ৩ থেকে ৫ বছরের ভিতরেই সম্ভব।

 

 

এ খামারটি মাংস উৎপাদনের জন্য করা হয়েছে। সাথে থাকছে ছাগলের বাচ্চা উৎপাদন। খামারটিতে এখনো বাণিজ্যিক ভাবে বিক্রি শুরু হয়নি। তবে পরিচিত কিছু মানুষের অনেক আগ্রহ ও জোড়াজুড়ির কারণে কিছু ছাগল বিক্রি করতে হয়েছিল। একটি বয়ার জাতের ছাগল বছরে ৬০ থেকে ৭০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে এই খামার থেকে আগামী একবছর পরে মাংসের জন্য অনেক ছাগল বিক্রি করতে পারবেন।

 

 

তারা এক বছর পর একটি বাচ্চা ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন। তাদের খামারে ছাগলের ঘাস খাওয়ানোর জন্য ছোট ছোট করে কাটা হচ্ছে পাকচং নামে এক জাতের ঘাস। এটি নরম এবং কচকচে হয়ে থাকে।

 

 

এ ঘাস উৎপাদন ক্ষমতা খুব বেশি, যা খেয়ে ছাগল খুব মজা পায়। এখানে একজন কেয়ারটেকার রয়েছে, যিনি ছাগলের যত্ন আত্তি করে থাকেন। তিনি সবসময় খামারে থাকেন। বিদেশী ছাগল দেখতে খুব সুন্দর হয় বলে, এই ছাগলদের তিনি খুব আদর করেন। খামারে তারা এক সাথে ২০০ কেজি দানাদার খাবার তৈরি করেন।

 

 

এতে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উপাদান মিশ্রিত থাকে। ভুট্টা ভাঙ্গা ৮০ কেজি, সয়াবিনের খৈল ৬০ কেজি, গমের ভুসি ৪৮ কেজি, লাইমস্টোন ৬ কেজি, লবণ ২ কেজি, বিট লবণ ২০০ গ্রাম, ভিটামিন প্রিমিক্স ৪ কেজি, ইস্ট সাপ্লিমেন্ট ২০০ গ্রাম, খাবার সোডা ৪০০ গ্রাম, কালোজিরা ২০০ গ্রাম ইত্যাদি মিশ্রন করেন।

 

 

এই পরিমাপে তারা দানাদার খাবার তৈরি করে রেখে দেন। তারপর প্রতিদিন এখান থেকে খাবার সরবরাহ করেন। কালোজিরা খাওয়ানোর উদ্দেশ্য হল, মাতৃ ছাগলের দুধের পরিমাণ যেন বৃদ্ধি পায়। ছাগলের বয়স ওজন এবং গর্ভবতী কিনা, এগুলো বিবেচনা করে ছাগলকে খাবার দিতে হয়।

 

 

এক মাস বয়সের বাচ্চা মায়ের দুধের পাশাপাশি ঘাসের সাথে পরিচিত করা হয়। তিন মাস বয়স হলে ছাগলকে খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হয়। ছাগল গুলো যখন পেগনেট হওয়ার সময় হয়, তখন প্রোটিন ও ফ্যাট এর মাত্রা কমিয়ে দিতে হয়।

 

 

একেক সময়, একেক বয়সের পরিমাপে খাবার দিতে হয়, যেন স্বাস্থ্য ঠিক থাকে। পিপিআর নামে এক ধরনের মারাত্মক রোগ হয় ছাগলের। একটি ছাগল এই রোগে ৭২ ঘন্টায় মধ্যে মারা যায়। এদের ভ্যাকসিন সময় মত দিতে হয়। ছাগলের ঠান্ডা লাগতে পারে, পেট ফেঁপে যেতে পারে, এর জন্য ওষুধ খাওয়াতে হয়। ছাগলের আচরণ দেখে বুঝে নিতে হবে, তার এখন কি অসুখ হয়েছে।

 

 

মলিন মনে করেন, তারা খামারে সফল হয়েছেন। ঠিক মতো পরিকল্পনা করে যদি কেউ ছাগলের খামার গড়ে তোলেন, তাহলে তারা অবশ্যই একদিন সফল হবেন।

 

তথ্যসূত্রঃ নিলান্ড ডট কম