মাল্টা আর চুই ঝাল চাষ করে এখন কোটিপতি হওয়ার হাতছানি

পুঁজি এক একর জমি আর দশ লাখ টাকা। যেখানে মাল্টা আর চুই ঝাল (চৈ ঝাল) চাষ করে এখন কোটিপতি হওয়ার হাতছানি। দিন বদলানোর এই গল্পটা খুলনার এক শিক্ষিত তরুণের। যিনি ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স করেও কৃষির রসায়নটা রপ্ত করে স্বপ্ন বুনেছেন। হয়ে গেছেন এলাকার মডেল কৃষক। নাম তাঁর সুব্রত মন্ডল।

 

 

খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার পার বটিয়াঘাটা গ্রামে তাঁর বসবাস। খুলনা সরকারি ব্রজলাল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ (বিএল কলেজ) থেকে ইংরেজিতে স্নাতক শেষে চাকরি করছিলেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পে। প্রকল্প শেষ হলেই আবার বেকার হয়ে ভুগছিলেন আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায়।

 

 

তাই আরেকটি চাকরি খোঁজার পাশাপাশি চাকরি হারালে অর্থনৈতিক ঝুঁকির কথা মাথায় উঁকি দিচ্ছিলো বারবার। অর্থনৈতিক মুক্তির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কৃষিকেই যুতসই মনে করে সুব্রত নেমে পড়েন নতুন সংগ্রামে।

 

 

দেখতে শুরু করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কৃষির নানা প্রযুক্তি ও সাফল্যের ভিডিও, ঘুরতে শুরু করেন বিভিন্ন বৃক্ষ মেলায়। ইউটিউব দেখে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাল্টা বাগন পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে ধারণা নিয়ে দুই বছর আগে বিলের ধানি জমিতে মাটি তুলে উঁচু করে মাল্টা চাষের উপযোগী করেন তরুণ প্রজন্মের এই কৃষক।

 

 

বর্ষা মৌসুমের শুরুতে জুন মাসের দিকে হর্টিকালচার সেন্টার থেকে বারি-১ জাতের মাল্টা চারা সংগ্রহ করে রোপন করেন। দুই গাছের ফাঁকে লাগান চৈ -ঝালের চারা। আর জমির সীমানা বরাবর রোপন করেন সিডলেস লেবুর চারা। দুই বছর পার হতেই বিনিয়োগের দশ লাখ টাকা উঠে এসেছে তার। বাগানে যে পরিমাণ চুই ঝাল আছে শুধু তা বিক্রি করলেই আসচে অন্তত ৫০ লাখ টাকা।

 

 

কৃষি প্রতিদিনকে সুব্রত জানান, তাঁর বাগানে মাল্টা গাছ রয়েছে ৩শ’ ৮টি। আর চুই ঝাল (চৈ-ঝাল) গাছ রয়েছে প্রায় ১৮শ’। এর পাশাপাশি সিডলেস (বিচিবিহীন) লেবুর গাছ রয়েছে ১শ’ ৪০টি। বাগান শুরুর বছর পার হতেই মাল্টা ধরতে শুরু করেছে বলে জানান ইংরেজি সাহিত্যে পড়া এ তরুণ। তবে তা বিক্রি করেন নি। প্রথম বছর আত্নীয়-স্বজন ও প্রতিবেশিদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। বিক্রি করতে শুরু করেছেন চৈ-ঝাল।

 

 

সুব্রত বলেন, যখন তিনি ইউটিউব দেখে বিভিন্ন এলাকায় মাল্টার বাগান, বা বৃক্ষ মেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন তখন অনেকেই এগুলোকে পাগলামি ভাবতো। পরিবারের সদস্যরাও চাকরি খোঁজায় মনযোগি না হয়ে এসব করায় খুব দু:শ্চিন্তায় পড়ে যান, ক্ষুব্ধ হন তাঁর উপর।

 

 

বলেন, ”প্রচলিত কৃষির বাইরে কিছু করতে গেলে কেমন হবে এমন দুচিন্তায় পড়ে বাবাও আমাকে জমি দিতে চাননি। পরে অনেক জোরাজুরিতে এক একর জমি ছেড়ে দিতে রাজি হন তিনি, তবে খুব মনক্ষুন্ন হয়েছিলেন বাবা। এখন এই বাগান তিনিই দেখাশুনা করছেন।”

 

 

আগে এই জমিতে বছরে ৬০ থেকে ৭০ মণ ধান পাওয়া যেত, টাকার হিসাবে আয় ছিল ৬০ থেকে ৭০ হাজার। আর এখন বছরে কম করে হলেও ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা আয় করার স্বপ্ন দেখছেন বলে জানান কৃষির এই নতুন স্বপ্নবাজ তরুণ।

 

 

সুব্রত মন্ডলের বাবা নিহার রঞ্জন মন্ডল কৃষি প্রতিদিনকে বলেন, “আমরা পুরাতন ধ্যান-ধারণার মানুষ। নতুন কিছু করতে গেলে কী হবে ভেবে ঝুঁকি নিতে রাজি হইনি। তাছাড়া ছেলেকে কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়েছে চাকরি করে সুন্দর ভবিষ্যত করবে, কৃষিকাজ কেন করবে?”

 

 

ছেলের সাফল্যে নিজের চিন্তা চেতনায়ও পরিবর্তন এসেছে জানিয়ে নিহার রঞ্জন বলেন, আসলে কোন কাজেই লজ্জা পাওয়া উচিত না। কৃষিকাজেও যে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয় তাঁর ছেলেই এখন বড় প্রমাণ।

 

 

শুরু থেকে সুব্রতকে সহায়তা দিয়ে এসেছে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কৃষি কর্মকর্তারা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন এ মিশ্র বাগানের। সুব্রত’র বাগানকে মডেল বাগান হিসেবে বেছে নিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সোমবার কৃষি সচিবসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শন করেছেন এলাকায় মডেল কৃষকের পরিচিতি পাওয়া সুব্রত’র বাগান।

 

 

কৃষি কর্মকর্তার হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে এই জমিতে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকার চুইঝাল রয়েছে। আর আগামী বছর কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করতে পারবেন। প্রতি বছর মাল্টার উৎপাদন বাড়বে। বর্তমানে সার্বক্ষণিক একজন শ্রমিক রেখেছেন সুব্রত, বাগানের লেবু বিক্রির টাকা থেকেই হয়ে যাচ্ছে তার বেতন।

 

 

মাল্টা বাগান আর চৈ-ঝাল সফল চাষি হিসাবে যাত্রা শুরু করে সুব্রত এখন বাড়তি আয় করছেন চৈ- ঝালের চারা তৈরী করে। প্রতি চৈ- ঝালের চারা বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা।

 

 

খুলনা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক [উদ্যান ] মহাদেব চন্দ্র সানা বলেন, সুব্রত মন্ডলের সাফল্যের গল্প ছড়িয়ে পড়ায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্থানীয় কৃষিতে। কৃষকদেরকে এখন সহজেই উদ্বুদ্ধ করতে পারছেন তাঁরা।

 

 

তিনি বলেন, আগে খুলনায় যেখানে ২৫ হেক্টর জমিতে চৈ -ঝাল চাষ হত এখন তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কৃষকদের সার্বিকভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। তার এখন ৫০ হেক্টর জমিতে হচ্ছে।

 

 

চৈ- ঝাল মূলত বাংলাদেশের দক্ষিণ–পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলোয় মসলা হিসেবে খুব জনপ্রিয়।

 

তথ্যসূত্রঃ কৃষি প্রতিদিন