স্থানীয়রা যেই জলজ প্রাণীটিকে দেখে ভয় পেতেন, ফসল ক্ষেতের জন্য ক্ষতিকরও ছিল, সেই প্রাণী এখন অনেকের সচ্ছলতা এনে দিয়েছে। দেশে বর্তমানে কয়েক কোটি টাকার রফতানি পণ্য এটি!
দেশের হাতে গোনা কয়েকটি জেলার পাশাপাশি মেহেরপুরেও চাষ হচ্ছে সেই ‘অবাঞ্ছিত’ জলজ প্রাণী কুঁচিয়া। স্থানীয়ভাবে কুঁচে, কুঁচে মাছ, কুইচ্চা বা কুঁচে বাইম নামেও পরিচিত। ইংরেজিতে বলা হয় এশিয়ান ইল। কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এটি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ এই মাছ ভক্ষণ তো দূরের কথা, সংস্পর্শই এড়িয়ে চলে।
এই কুঁচিয়ার বাণিজ্যিক খামার গড়ে উঠেছে মেহেরপুরের বিভিন্ন গ্রামে। রফতানি হচ্ছে চীন, কম্বোডিয়া, জাপান, হংকং, মঙ্গোলিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াসহ প্রায় ১৫টি দেশে। জেলায় ২০০ বাণিজ্যিক খামার গড়ে উঠেছে। লাভজনক হওয়ায় আরো অনেকে খামার গড়ায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলায় এক হাজার মানুষ বর্তমানে কুঁচিয়া চাষের সঙ্গে জড়িত। মেহেরপুর সদর উপজেলার বাড়িবাকা, উজ্জলপুর, বৈকুণ্ঠপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের পিছিয়ে পড়া ৫২ জন কৃষক প্রশিক্ষণ নিয়ে গর্ত পদ্ধতিতে কুঁচিয়া চাষ করছেন। গাংনী উপজেলার সাহারবাটি, নিত্যানন্দপুর, যুগিন্দা, পাকুরিয়াসহ আরো বিভিন্ন গ্রামের শতাধিক বেকার যুবক পরীক্ষামূলকভাবে চাষ শুরু করেছেন।
মেহেরপুর পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) অর্থায়নে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন দারিদ্র্য বিমোচন সংস্থা (ডিবিএস) এ ব্যাপারে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ ও নানা সহযোগিতা দিচ্ছে।
মেহেরপুর পিকেএসএফের সহকারী প্রকল্প সমন্বয়কারী সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, আমরা জেলার সদরে ডিবিএস ও গাংনী উপজেলায় পলাশীপাড়া সমাজকল্যাণ সংস্থার মাধ্যমে ৮০০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। বর্তমানে জেলার এক হাজার চাষী এ কুঁচিয়া চাষে জড়িত। বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে ২০০ খামার।
এ ব্যাপারে গাংনী পলাশীপাড়া সমাজকল্যাণ সংস্থার নির্বাহী প্রধান মোশারেফ হোসেন বলেন, পিকেএসএফের আর্থিক সহযোগিতায় তারা গাংনী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কয়েকশ দরিদ্র কৃষককে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ করে ডিচ করে দিয়েছেন। সব ধরনের উপকরণ ও সার্বিক তদারকিও করছেন তারা। ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। গাংনীতে আগামী মাসেও ৩০ জন আগ্রহী কৃষককে তারা প্রশিক্ষণ দেবেন।
গাংনী উপজেলার সাহারবাটি গ্রামের এনামুল হক ও সুমন হোসেন জানান, কুঁচিয়া চাষ করে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। নিত্যানন্দপুর গ্রামে বিকাশ কুঁচিয়া চাষের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানান, বাড়ির পাশে দুতিন শতক জায়গায় কৃত্রিম পুকুর করে কুঁচিয়া চাষ করা যায়। পুকুরের তলদেশে পলিথিন বিছিয়ে কাদামাটি ছড়িয়ে দিতে হয়।
পানিতে সরাসরি সূর্যালোক যাতে না পড়ে সে জন্য দিতে হয় কচুরিপানা বা তালপাতা। অনেকে পাকা ড্রাম পদ্ধতিতেও কুঁচিয়ার প্রজনন ও চাষ করছেন। প্রতিটি ১২ঢ২৪ ফুটের ডিচ (কৃত্রিম পুকুর) বা ড্রাম নির্মাণ ও আট মাস খাবার খরচ বাবদ ব্যয় হয় ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা। এ কুঁচিয়া বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব। তিনি আরো জানান, স্থানীয় আড়তদাররা খামারিদের কাছ থেকে কুঁচিয়া কিনে ঢাকার রফতানিকারকের কাছে বিক্রি করে।
মেহেরপুর জেলা মত্স্য বীজ উৎপাদন খামারের ব্যবস্থাপক ড. আসাদুজ্জামন মানিক জানান, কুঁচিয়া একটি চমত্কার খাদ্যমানসম্পন্ন সুস্বাদু মাছ। আন্তর্জাতিক বাজারে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে, দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে এ মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিদেশে রফতানির পথকে আরো সুগম করা গেলে জেলার কুঁচিয়া চাষীরা আরো বেশি লাভবান হতেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে ১৯৭৭ সালে প্রথম কাঁকড়া ও কুঁচিয়া রফতানি শুরু হয়। ওই সময় অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে এই দুই পণ্য রফতানি বাজার ছিল মাত্র দুই হাজার ডলারের।
রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ সালে জীবিত মাছ হিসেবে ৭০ হাজার ১৭৫ টন কুঁচিয়া রফতানি করে বাংলাদেশ প্রায় দেড় কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। এ আয় প্রতি বছরই বাড়ছে।
তথ্যসূত্র: বনিক বার্তা।