ঘরের ভেতর মাছ চাষ করুন আরএএস পদ্ধতিতে, উৎপাদন হবে ৩০ গুণ

ক্যাম্পাস প্রতিনিধিঃ ‘ডাঙায় চরে রুই-কাতলা!’ সেই কবে মজা করে লিখেছিলেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার। এবার সত্যি সত্যি ময়মনসিংহ শহরে পুকুর কিংবা খালের বদলে শিং, পাবদার চাষ হচ্ছে ডাঙায়, একেবারে ঘরের ভেতর। উৎপাদনও অনেক গুণ।

 

 

পুকুরে যেখানে প্রতি ঘনমিটার পানিতে মাছের উৎপাদন মাত্র এক থেকে দুই কেজি, সেখানে ঘরের মধ্যে চাষে উৎপাদন ষাট কেজি পর্যন্ত! শুনে হয়তো খটকা লাগতে পারে। কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে এসেছে এই সফলতা।

 

 

আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ঘরের ভেতর মাছ চাষ করে পুকুরের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি উৎপাদন সম্ভব। বছরে ১০ টন শিং-মাগুর মাছ উৎপাদনের জন্য অন্তত ১০ বিঘা পুকুর প্রয়োজন। এ প্রযুক্তিতে মাত্র ৬-৭ কাঠা জমিতে সে পরিমাণ মাছ উৎপাদন সম্ভব।

 

 

অর্থাৎ এক ঘনমিটার পুকুরে দুই কেজি মাছ হলে আরএএস (রিসার্কুলেটিং অ্যাকুয়াকালচার সিস্টেম) পদ্ধতিতে ৫০ থেকে ৬০ কেজি মাছ উৎপাদন করা যায়। বাংলাদেশে এ প্রযুক্তিতে প্রথম মাছ চাষ শুরু করেন ‘ফিশ হ্যাচারি ও কালচার ফার্ম অ্যাগ্রো থ্রি’র স্বত্বাধিকারী এবিএম শামসুল আলম বাদল। তিনি এ দাবি করেন।

 

 

ময়মনসিংহ শহরের বাসিন্দা আধুনিক মৎস্যচাষী এ বি এম সামসুল আলম। মাছ নিয়ে কেটেছে কুড়িটি বছর। এবার তিনি বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি রিসার্কুলেশন একুয়াকালচার সিস্টেমের (আরএএস) ক্ষুদ্র ভার্সন ‘মিনি আরএএস’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ চাষ শুরু করেছেন।

 

 

শহরের বিসিক শিল্পনগরীর একটি টিনশেডে ১০ টন ধারণ ক্ষমতার ৮টি ট্যাঙ্ক বসিয়েছেন। প্রতিটি ট্যাঙ্ক পাইপ দিয়ে মেকানিক্যাল ফিল্টার যুক্ত। এ ফিল্টার প্রতিটি ট্যাঙ্কের মাছ ও মৎস্য খাদ্যের বর্জ্য পরিষ্কার করে। পরে এ পরিষ্কার পানি পাম্প দিয়ে বায়োফিল্টারে তোলা হয়। মাছের বৃদ্ধি যেন বাধাগ্রস্থ না হয়, সে জন্য পানি পরিশোধন করা হয়।

 

 

তিনি জানান, ‘সার্বক্ষণিক ফিল্টারিংয়ের ফলে পানি পরিশোধন হয় আর পরিশোধিত পানির ১০ শতাংশ বর্জ্য হিসেবে বের হয়ে যায়। এটি আবার জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। মাছের খাবার নষ্ট হয় না। সাধারণত পুকুরে অক্সিজেনের স্বল্পতা থাকে, এখানে সে অসুবিধা নেই।’

 

 

৮০ শতাংশ পানি সম্পূর্ণ শোধন করে পুনর্ব্যবহার করা যায়। মেকানিক্যাল ও বায়োপরিশোধন প্রক্রিয়ায় মাছের বর্জ্য, খাদ্যাবশেষ, দ্রবীভূত এমোনিয়া, কার্বন ডাই-অক্সাইড এসব ক্ষতিকারক গ্যাস ৯০ শতাংশ পর্যন্ত অপসারণ সম্ভব। এসব উপাদান মাছের বৃদ্ধিতে ক্ষতিকারক।

 

 

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যতœআত্তি হয় বলে মাছের দ্রুত বৃদ্ধি হয় এবং মাছের গুণগত মান হয় উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত। নোংরা খাবার নেই বলে মাছের গন্ধ প্রাকৃতিক থাকে এবং দুর্গন্ধ থাকে না। সামসুল আলম শিং, গুলশা ও পাবদা চাষ করছেন। চার মাসে এগুলো বিক্রির উপযোগী হবে বলে জানান তিনি।

 

 

তখন প্রতিটি ট্যাঙ্কে প্রায় ছয়শত কেজি মাছ পাওয়া যাবে। মাত্র পাঁচ সপ্তাহে মাছ ওজনে বাড়ছে ১০ গ্রামের বেশি। এই প্রযুক্তিতে মাছের মৃত্যুহার নেই বললেই চলে। লাখে দুয়েকটা মারা যেতে পারে। আর দেখাশোনার জন্য দুজন লোকই যথেষ্ট।

 

 

১৯৮২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন সামসুল আলম। এরপর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে মাছ নিয়ে কাজ করেছেন। ময়মনসিংহের ত্রিশালে গড়ে তুলেছেন খামার। তিনি বাংলাদেশে প্রথম কুচিয়া চাষ শুরু করেছেন বলে জানালেন।

 

 

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন নামি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এখানে থিসিসের কাজ করতে আসে। এশিয়ার কয়েকটি দেশ ও বাংলাদেশে এ প্রযুক্তির প্ল্যান্ট নির্মাণ ও সহায়তা দিয়ে থাকে জ্যাক ইন্টারন্যাশনাল।

 

 

এই প্রতিষ্ঠানের সিইও জাহাঙ্গীর আলী জানান, ‘প্রকল্পটি ব্যয়বহুল, পাশাপাশি খুবই লাভজনক। একটি মিনি আরএএস নির্মাণ করতে খরচ লাগে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। তবে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে লাভসহ বিনিয়োগের পুরো টাকাই উঠে আসে। এসব প্ল্যান্ট পঞ্চাশ বছরের বেশি টিকে।

 

 

তবে এই প্রযুক্তিতে সার্বক্ষণিক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দরকার।’ আফ্রিকা ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে এই প্রযুক্তি চালু আছে বলে জানান তিনি। এই প্ল্যান্ট যে কেউ চাইলে শুরু করতে পারেন। সারা বছর সমান তালে মাছ উৎপাদন করা যাবে।

 

তথ্যসূত্রঃ আধুনিক কৃষি খামার