বরগুনায় প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করে মুক্তা চাষে সফলতা পেয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল ইসলাম। এরই মধ্যে তার মুক্তা চাষের সফলতার গল্প ছড়িয়ে পড়েছে গোটা জেলা জুড়ে।
নুরুল ইসলামের সফলতা দেখে এলাকার অনেকেই এখন মুক্তা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বরগুনাসহ দক্ষিণাঞ্চলে মুক্তা চাষের মাধ্যমে উম্মোচিত হতে পারে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জুয়েলারি, ওষুধ শিল্পে, কসমেটিক্স, পেইন্টস ফরমুলেসনে মুক্তা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। দেশে হাওড় ও বিলে প্রাকৃতিকভাবে মুক্তা পাওয়া গেলেও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। তাই এটি চাষের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হলে দেশীয় চাহিদা পুরনের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রাও অজর্ন করা সম্ভব। সেই সঙ্গে আর্থিকভাবে সফলতা তো রয়েছেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরগুনা সদর উপজেলার কেলতাবাড়িয়া গ্রামে ব্রাইট এগ্রো নামের একটি কৃষি খামার স্থাপন করেন অবসারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম। এতে পরামর্শ ও সার্বিক সহযোগীতা করেন তার আপন ছোট ভাই টেকসই উপকূলীয় মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম।
এই এগ্রো ফার্মেই ২০১৯ সালে মাছের পাশাপাশি ঝিনুকের মুক্তা চাষের প্রকল্প হাতে নেয় নুরুল ইসলাম। গড়ে তোলে একটি প্রদর্শনী খামার। প্রথমে মুক্তাচাষের প্রদর্শনী খামার গড়ে তুললেও এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষে আগ্রহী তিনি। তবে নুরুল ইসলামসহ আগ্রহী চাষিরা বলছেন মুক্তা চাষ করতে প্রয়োজন সরকারি সহায়তা।
খামারটিতে প্রাকৃতিক জলাধার থেকে মানসম্পন্ন ঝিনুক সংগ্রহ করে ঝিনুকের মুখ ফাঁক করে ঝিনুকের খোসার গুড়া ও ২ ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যের সংমিশ্রণে বিভিন্ন ধরনের ডাইচ ভেতরে স্থাপন করা হয়। এরপর মান্ডেল টিস্যুর সাহায্যে নেটে আটকিয়ে দেড় ফিট পানির নিচে ৩ ফিট দূরত্বে ফ্লুডের মাধ্যমে ৪৫দিন পানিতে ভাসিয়ে রাখতে হয়।
৪৫ দিনের মধ্যেই ইমেজটি ঝিনুকের খোলসের সঙ্গে আটকে যায়। ৪৫ দিন পরে নেটের ভেতরে মাটির প্রশস্ত বাসন জাতীয় পাত্রের ওপর আটকিয়ে রেখে খাদ্য হিসেবে প্লাংটন উৎপাদনের জন্য গোবর প্রয়োগ করার পর ৭ থেকে ৮ মাসের মধ্যে ঝিনুকের ভেতরে মুক্তা আহরণের উপযুক্ত হয়।
আর এসব কাজে ঝিনুক প্রতি ব্যয় হয় সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। বাড়ির পাশে পুকুর ও জলাধারে এরকম মুক্ত চাষ সম্ভব্য ব্যায়ের পরিমাণও কম। উৎপাদিত মুক্তা প্রতিটি গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বিক্রি হয়। প্রতিটি ঝিনুকের মধ্যে ৪ থেকে ৬টি মুক্তা উৎপাদন সম্ভব।
মুক্তা চাষের উদ্যোক্তা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, পুকুর বা জলাশয়ে এক সঙ্গে মুক্তা এবং মাছ চাষ করে যেকোনো পরিবার অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। ব্রাইট এগ্রোর মুক্তা চাষ প্রকল্প দেখতে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসছে । ব্রাইট এগ্রোর পক্ষ থেকে হাতে কলমে আগ্রহীদের ধারণা দেয়া হচ্ছে ঝিনুকের মুক্তা চাষের, পদ্ধতি কৌশল দেয়া ও পরিচর্যার বিষয়।
তিনি আরো বলেন, প্রতিটি ঝিনুক থেকে উৎপাদিত হয় ৪টি মুক্তা। বর্তমানে ৩ হাজারের বেশি মুক্তা উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে গ্রীসে অবস্থানরত বাঙালিরা মুক্তা সংগ্রহের ব্যাপারে যোগাযোগ করছেন। আগামী মাসে গ্রীসে প্রবাসী বাঙালিদের চাহিদা মতো ১ হাজার পিস মুক্তা পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ।
মুক্তা চাষে আগ্রহী লতবাড়িয়া গ্রামের আবদুস সোবাহান বলেন, আমাদের প্রচুর প্রাকৃতিক জলাধার রয়েছে। জলাধারগুলোতে প্রচুর ঝিনুক পাওয়া যায়। আমরা নুরুল ইসলামের প্রদর্শনী খামার দেখেছি। আমরা নিজেরাও মুক্তা চাষ করতে আগ্রহী। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এটা বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ সম্ভব।
একই এলাকার সহিদুল ইসলাম বলেন, আমিও মুক্তাচাষ শুরু করেছি। কিন্তু সরকারি সহায়তা পেলে এটা আরো ব্যাপক পরিসরে করা সম্ভব। সেই সঙ্গে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানও সম্ভব।
বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, বরগুনাসহ দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর প্রাকৃতিক জলাধার রয়েছে। যেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঝিনুক পাওয়া যায়। এই ঝিনুক সংগ্রহ করে মুক্তাচাষের আওতায় নিয়ে আসলে বরগুনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এ বিষয়ে বরগুনার ডিসি হাবিবুর রহমান বলেন, সরেজমিনে ঝিনুকের মুক্তা চাষের প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছি। বরগুনার মতো সম্ভাবনাময় এলাকায় মুক্তা চাষ একটি লাভজনক প্রকল্প। এই মুক্তাচাষ প্রকল্পটি প্রসারে এবং আগ্রহী কৃষকদের সহযোগীতা করা হবে।
তিনি আরো বলেন, বরগুনার এই উপকূলীয় এলাকায় এ ধরনের উদ্যোক্তার প্রয়োজন। তার এই উদ্যোগ দেখে আমি খুবই আনন্দিত। এলাকার বেকার যুবকরা একটু উদ্যোগী হলে মুক্তা চাষ প্রকল্প থেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে।