যেসব মাছ পূর্নবয়স্ক হলে ৫-২৫ সে মি পর্যন্ত আকারের হয় সাধারণত সেগুলোকে ছোট মাছ বলা হয়। প্রাচীনকাল থেকে মলা, পুঁটি, চেলা, চান্দা, চাপিলা, মেনি, বাইম, খলিশা, টেংরা, ফলি, পাবদা, শিং, মাগুর ইত্যাদি ছোট মাছ এ দেশের মানুষের বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর খাদ্য তালিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।
বিভিন্ন প্রজাতির এসব ছোট মাছে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থসহ খাদ্য ও পুষ্টিমান অনেক বেশি। পরিবেশের পরিবর্তন, আবাসস্থালেরর সংকোচন পুকুর জলাশয় সম্পূর্ণ সেচ করে সব মাছ ধরে ফেলা ও মনুষ্যসৃষ্ট নানাবিধ কারণে এসব প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্তির পথে। দেশের সামগ্রিক মৎস্য উৎপাদন ও প্রাচুর্য্যতায় ছোট মাছের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে তাই আজ দেশীয় ছোট মাছ সংরক্ষণ ও চাষ সম্প্রসারণ অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছোট মাছের গুরুত্ব
ছোট মাছে প্রচুর পরিমাণ আমিষ এবং অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিড বিদ্যমান।
অনেক ক্ষেত্রে বড় মাছের তুলনায় ছোট মাছের পুষ্টিমান বেশি। ছোট মাছে প্রচুর পরিমানে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মত খনিজ পদার্থ আছে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে।
মলা–পুঁটি মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ আছে যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে।
গর্ভবতী মহিলা ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের রক্তশূন্যতা থেকে রক্ষায় ছোট মাছ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
প্রাকৃতিক জনজ পরিবেশে এরা বংশ বিস্তার করে। ফলে প্রতি বছর আলাদা করে পোনা মজুদ করতে হয় না।
সব ধরণের জলাশয়ে এদের চাষ করা যায় এবং চাষে সময়ও কম লাগে।
ছোট মাছ ওজনের অনুপাতে সংখ্যায় বেশি হয় বলে পরিবারের সদস্যদের মাঝে বন্টনের সুবিধা হয়।
মলা, চেলা ও পুঁটির চাষ প্রযুক্তি
এ মাছ চাষের বৈশিষ্ট্য
একক ও মিশ্র উভয় পদ্ধতিতে চাষ করা হয়।
প্রাকৃতিকভাবে বছরে ২–৩ বার প্রজনন করে থাকে।
সহজ ব্যবস্থাপনায় চাষ করা যায়।
যে কোন ছোট জলাশয়ে চাষ করা যায়।
পুকুর নির্বাচন
জলাশয়টি বন্যামুক্ত হতে হবে।
পানির গভীরতা ১–১.৫ মিটার হলে ভালো হয়।
জলাশায়ে আলো বাতাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
পুকুর প্রস্তুতি, পোনা মজুদ, খাদ্য ও সার প্রয়োগ
পুকুরের পাড় মেরামত করে শতাংশ প্রতি ১ কেজি চুন ও ৪–৫ কেজি গোবর প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রয়োগের ৩–৪ দিন পর প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মালে ছোট মাছ ছাড়তে হবে।
একক চাষের ক্ষেত্রে শতাংশ প্রতি ৪০০–৫০০টি মলা/ঢেলা/পুঁটি চাষ করা যায়।
মাছ ছাড়ার পরদিন হতে মাছের দেহ ওজনের শতকরা ৫–১০% হিসাবে চালের কুঁড়া, গমের ভূষি ও সরিষার খৈল সম্পূরক খাবার হিসেবে দেয়া যেতে পারে।
প্রাকৃতিক খাবার তৈরির জন্য ৭দিন অন্তর অন্তর শতাংশ প্রতি ৫–৬ কেজি গোবর অথবা ২–৩ কেজি হাঁস–মুরগির বিষ্ঠা দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
রুইজাতীয় মাছের সাথে মলা–পুঁটির মিশ্র চাষ
পুকুর / মৌসুমী জলাশয় নির্বাচন:
দো–আঁশ ও এটেল দো–আঁশ মাটির পুকুর ভালো।
পুকুর/জলাশয় বন্যামুক্ত এবং মাঝারী আকারের হলে ভালো হয়।
পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ে এমন পুকুর নির্বাচন করা উচিত।
পানির গভিরতা ১–১.৫ মিটার হল ভালো।
পুকুর প্রস্তুতি
পাড় মেরামত ও আগাছা পরিস্কার করতে হবে।
রাক্ষুসে ও ক্ষতিকর প্রাণী অপসারণ করতে হবে।
শতাংশে ১ কেজি করে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
চুন প্রয়োগের ৭–৮ দিন পর শতাংশ প্রতি ৫–৭ কেজি গোবর ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি সার দিতে হবে।
পোনা মজুদ, খাদ্য ও সার প্রয়োগ
শতাংশ প্রতি ১০–১৫ সে.মি. আকারের ৩০–৩২টি রুইজাতীয় পোনা এবং ৫–৬ সে.মি. আকারের ৬০টি মলা ও ৬০টি পুঁটি মাছ মজুদ করা যায়।
মাছের পোনা মজুদের পরদিন থেকে পোনার দেহের ওজনের শতকরা ৫–১০ ভাগ হারে সম্পূরক খাবার হিসেবে খৈল, কুড়া, ভূষি দেয়া যেতে পারে।
গ্রাস কার্পের জন্য কলাপাতা, বাধা কপির পাতা, নেপিয়ার বা অন্যান্য নরম ঘাস দেয়া যেতে পারে।
মলা–পুঁটি মাছের জন্য বাড়তি খাবার দরকার নাই।
প্রাকৃতিক খাবার জন্মানোর জন্য পোনা ছাড়ার ১০ দিন পর শতাংশ প্রতি ৪–৬ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে।
মাছ আহরণ
পোনা মজুদের ২ মাস পর হতে ১৫ দিন পর পর বেড় জাল দিয়ে মলা–পুঁটি মাছ আংশিক আহরণ করতে হবে।
৭৫০–৮০০ গ্রাম থেকে কেজি ওজনের কাতলা ও সিলভার কার্প মাছ আহরণ করে সমসংখ্যক ১০–১২ সে.মি. আকারের পোনা পুনরায় মজুদ করতে হবে।
বছর শেষে চূড়ান্ত আহরণ করা যেতে পারে।
ধানক্ষেতে ছোট মাছ চাষ
সাধারণ দুই পদ্ধতিতে ধান ক্ষেতে মাছ করা যায়ঃ
ক) যুগপৎ পদ্ধতি। খ) পর্যায়ক্রমে পদ্ধতি।
ধান ও মাছ একই জমিতে একসঙ্গে চাষ করাকে যুগপৎ পদ্ধতি বলে।
জমি নির্ধারণ
এটেল বা দো–আঁশ মাটির জমি সবচেয়ে ভাল।
জমি বন্যামুক্ত হতে হবে।
জমিতে অন্ততঃ ৩ মাস কমপক্ষে ২০–৩০ সে.মি. পানি থাকতে হবে।
জমি অপেক্ষাকৃত সমতল হলে ভাল হয়।
জমি প্রস্তুতি
জমি ভালভাবে চাষ দেয়ার পর মই দিয়ে সমান করে নিতে হবে যেন সর্বত্রই গভীরতা সমান থাকে।
আইল নির্মাণ, গর্ত ও নালা খনন
প্রয়োজনমত পানি ধরে রাখার জন্য ৩০–৪৫ সে.মি. উঁচু, শক্ত ও প্রশস্থ আইল বাঁধতে হবে।
ধানক্ষেতে মাছের আশ্রয়স্থল হিসেবে নালঅ এবং গর্ত বা মিনি পুকুর অবশ্যই থাকতে হবে। জমির অপেক্ষাকৃত ঢালু অংশে শতকরা ৪–৬ ভাগ এলাকায় ০.৭৫–১.০ মিটার গভীর করে গর্ত করতে হবে।
পোনা মজুদ ও খাদ্য সরবরাহ
ধানের চারা রোপনের ১৫–২০ দিনের মধ্যে চারা ভালভাবে মাটিতে লেগে গেলে জমিতে ১২–১৫ সে.মি. পানি ঢুকিয়ে পোনা ছাড়া যাবে।
কমন কার্প/মিরর কার্প এবং থাই–সরপুঁটির সাথে মলার মিশ্রচাষ অথবা মলা–পুঁটি মিশ্রচাষ করা যেতে পারে।
মিশ্রচাষে প্রতি শতাংশে মলা ৫০–৬০টি, কমন/মিরর কার্প ৬–৮টি এবং থাই সরপুঁটি ১০–১২টি ছাড়া যায়।
ধানের সাথে মাছ চাষে বাহির থেকে খাবার দেয়ার প্রয়োজন হয়না। তবে বেশি উৎপাদন পাওয়ার জন্য মাছের ওজনের শতকরা ২–৩ ভাগ সরিষার খৈল ও চালের কুড়া প্রতিদিন গর্তে বা নালায় প্রয়োগ করতে হবে।
মাছ আহরণ
ধান কাটার পর পানি কমিয়ে ক্ষেত থেকে মাছ ধরতে হবে।
প্রতি শতাংশে মলা ০.৫০ কেজি এবং কার্প ২.০ কেজি এবং মলা পুঁটি চাষ করলে প্রতি শতাংশে ০.৬ কেজি মলা–পুঁটি পাওয়া যেতে পারে।
ছোট মাছ সংরক্ষণ কৌশল
পুকুর
ছোট মাছকে অবাঞ্জিত মাছ হিসেবে গণ্য না করে সেগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ ও চাষের আওতায় আনতে হবে। জলজ পরিবেশের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ছোট মাছের বংশ বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করে এর উৎপাদন বাড়ান।
স্থানীয়ভাবে প্রাপ্য দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ পুকুরে মজুদ ও সংরক্ষণ করা।
ছোট মাছের বংশ বৃদ্ধির জন্য পুকুরে নিয়োজিত মাত্রায় কিছু জলজ আগাছা রাখা।
জলাশয় বা পুকুর সম্পূর্ণ সেচে সকল মাছ আহরণ না করা।
ছোট মাছের প্রজনন মৌসুম (জ্যৈষ্ঠ–আষাঢ়) সম্পর্কে সংষ্লিষ্ট জনগণকে সচেতন করা এবং সে সময় পুকুর ছোট ফাঁসের জাল টানা থেকে বিরত থাকা।
ধানক্ষেতে ছোট প্রজাতির মাছ চাষের ব্যবস্থা করা।
প্রাকৃতিক জলাশয়ে
বিল, হাওর ও বাওড়ে অভয়াশ্রম স্থাপন করা।
ছোট মাছের প্রধান প্রজনন মৌসুম বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস, এ সময় প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ ধরা বন্ধ রাখা।
জলাশয়ের পানি সেচে মাছ না ধরা।
ছোট মাছের গুরুত্ব ও এর সংরক্ষণ সম্পর্কে জলাশয়ের আশেপাশের জনগণকে সচেতন করা এবং সংরক্ষণ কাজে সম্পৃক্ত করা।
মৌসুমী জলাভূমিগুলোর কিছু অংশ খনন করে প্রজননক্ষম মাছ সংরক্ষণ করা, যাতে তারা বর্ষা মৌসুমে; ডিম পাড়তে পারে।
তথ্যসূত্রঃ আধুনিক কৃষি খামার