মাছ চাষে পুকুরের আয়তন, গভীরতা ও খাদ্য প্রয়োগ নিয়ে মৎস্য চাষিদের সঠিক ধারণা থাকা জরুরী। পুকুরে মাছ চাষ করে লাভবান হওয়ার জন্য পুকুরের আয়তন, গভীরতা ও খাদ্য প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকের এই লেখায় আমরা জেনে নিব মাছ চাষে পুকুরের আয়তন, গভীরতা ও খাদ্য প্রয়োগ সম্পর্কে-
মাছ চাষে পুকুরের আয়তন, গভীরতা ও খাদ্য প্রয়োগঃ
মাছ চাষের পুকুরের গড় গভীরতা ৫-৭ ফুট থাকলে পুকুরে বেশী পরিমান অক্সিজেন এবং পানির তাপমাত্রা সঠিক থাকে। যে কারনে খাদ্য দ্রুত হজম হয় পাশাপাশি মাছের দৈহিক বৃদ্ধির হার ভাল হয়। কম গভীর পুকুরে অক্সিজেনের সল্পতার কারনে খাদ্যের অপচয় বেশী হয় এবং এফসিআর মান খারপ হয়।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় পুকুরের আয়তন বেশী (এক একরের বেশী) বড় হলে খাদ্য প্রয়োগে সমস্যা দেখা যায়। বিশেষ করে মাছ পুকুরের সকল জায়গায় বিচরণ করে, খাদ্য প্রয়োগের সময়কাল কম হলে দূরের মাছ এসে খাবার গ্রহন করতে পারে না।
কিছু মাছ বেশী খাবার গ্রহন করে আবার কিছু মাছ কম, এতে মাছের সাইজ ছোট বড় হয়ে থাকে। যার ফলে মোট উৎপাদন ব্যহত হয়। ফলে এফসিআর হয় দুর্বল। সেজন্য পুকরের আয়তন বড় হলে প্রয়োজনে আস্তে আস্তে বেশী সময় ধরে খাদ্য প্রয়োগ করা।
খাবার প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সাধারন নিয়ম অনুসরন করা জরুরী যেমনঃ মাছের আকার ও বয়স অনুযায়ী খাদ্যের পিলেট সাইজ পরিবর্তন করতে হবে। ছোট মাছকে বেশী প্রোটিণ যুক্ত ও সহজে হজম যোগ্য খাবার প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি ছোট মাছকে বড় মাছের তুলনায় ঘনঘন খাবার দিতে হবে (দৈনিক ৪-৫ বার)। বড় মাছের ক্ষেত্রে ৩-৪ বার খাবার প্রয়োগ করলে খাবারের অপচয় রোধ হবে এবং এফসিআর মান উন্নত হবে।
আদর্শ পুকুরের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকে:
* মাছ চাষের পুকুরের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার যা চাষ প্রক্রিয়াকে লাভজনক করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। একটি আদর্শ মাছ চাষের পুকুরের যেসব বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা দরকার তা জেনে নিন।
* পুকুরটি বন্যামুক্ত হবে। এজন্য পুকুরের পাড় যথেষ্ট উঁচু হতে হবে।
* পুকুরের মাটি দোআঁশ, পলি-দোআঁশ বা এঁটেল-দোআঁশ হলে সবচেয়ে ভালো।
* সারা বছর পানি থাকে এমন পুকুর চাষের জন্য বেশি উপযুক্ত।
* পুকুরের পানির গভীরতা ০.৭৫ থেকে ২ মিটার সুবিধাজনক।
* পুকুরটি খোলামেলা স্থানে হলে ভালো হয় এবং পাড়ে বড় গাছপালা থাকবে না। এতে পুকুর প্রচুর আলো-বাতাস পাবে। ফলে পুকুরে সালোকসংশ্লেষণ বেশি হবে ও মাছের খাদ্য বেশি তৈরি হবে। পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন মিশবে। উত্তর-দক্ষিণমুখী পুকুর সূর্যের আলো বেশি পাবে।
* পুকুরের তলায় অতিরিক্ত কাদা থাকা উচিত নয়। তলার কাদার পুরুত্ব ২০ থেকে ২৫ সে.মি. এর বেশি হওয়া ঠিক নয়।
* চাষের পুকুরের আয়তন ২০ থেকে ২৫ শতক হলে ব্যবস্থাপনা সহজ হয়। পুকুরের আকৃতি আয়তাকার হলে ভালো। এতে করে জাল টেনে মাছ ধরা সহজ হয়।
* পুকুরের পাড়গুলো ১:২ হারে ঢালু হলে সবচেয়ে ভালো। অর্থাৎ, পুকুরের তলা হতে পুকুরের পাড় যতটুকু উঁচু হবে পাড় ঢালু হয়ে পুকুরের তলার দিকে দ্বিগুণ দূরত্বে গিয়ে মিশবে।
মাছ চাষের জন্য পুকুরের পানির যেসব গুণাগুণ থাকা দরকার:
মাছের বেঁচে থাকা, খাদ্যগ্রহণ ও আশানুরূপ বৃদ্ধির জন্য পুকুরের পানির গুণাগুণ অনুকূল মাত্রায় থাকা দরকার। পুকুরে পানির গুণাগুণকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়,-
* ভৌত গুণাগুণ
* রাসায়নিক গুণাগুণ।
ভৌত গুণাগুণ:
* গভীরতা: পুকুর বেশি গভীর হলে সূর্যের আলো পুকুরের গভীরতার শেষ সীমা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। ফলে অধিক গভীর অঞ্চলে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য প্লাংকটন তৈরি হয় না। আবার সেখানে অক্সিজেনের অভাব হতে পারে। অন্যদিকে পুকুর অগভীর হলে গ্রীষ্মকালে পুকুরের পানি অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়। এসব কারণে মাছের ক্ষতি হতে পারে ও উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
* সূর্যালোক: যে পুকুরে সূর্যালোক বেশি পড়ে সেখানে সালোকসংশ্লেষণ ভালো হয়। ফলে সেখানে ফাইটোপ্লাংটন বেশি উৎপাদিত হয় ও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
* তাপমাত্রা: তাপমাত্রার বৃদ্ধির উপর মাছের বৃদ্ধির নির্ভর করে। যেমন: মাছের বৃদ্ধি কমে যায়। এ কারণে শীতকালে পুকুরে সার ও খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়। রুই জাতীয় মাছের বৃদ্ধি ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সবচেয়ে ভালো হয়।
* ঘোলাত্ব: কাদা কণার কারণে পুকুরের পানি ঘোলা হলে পানিতে সূর্যালোক প্রবেশে বাঁধা পায়। এতে করে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়।
রাসায়নিক গুণাগুণ:
* দ্রবীভূত অক্সিজেন: পুকুরের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন মাছ চাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানত ফাইটোপ্লাংকটন ও জলজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় যে অক্সিজেন তৈরি করে পুকুরের পানিতে দ্রবীভূত হয়। বায়ুমণ্ডল হতে সরাসরি পানির উপরিভাগেও কিছু অক্সিজেন মিশ্রিত হয়। পুকুরে বসবাসকারী মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণি এ অক্সিজেনি দিয়ে শ্বাসকার্য চালায়।
রাতে সূর্যের আলোর অভাবে সালোকসংশ্লেষণ হয় না বলে পানিতে কোনো অক্সিজেন তৈরি হয় না। এজন্য সকালে পুকুরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় ও বিকেলে বেশি থাকে। মাছ চাষের জন্য পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমপক্ষে ৫ মিলিলিটার (৫ পিপিএম বা ১ মিলিয়ন ভাগের পাঁচ ভাগ) থাকা প্রয়োজন।
* দ্রবীভূত কার্বনডাই অক্সাইড: পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য ফাইটোপ্লাংকটনের উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত দ্রবীভূত কার্বনডাই অক্সাইড থাকা প্রয়োজন। তবে মাত্রাতিরিক্ত কার্বনডাই অক্সাইড মাছের জন্য ক্ষতিকর। পানিতে কার্বনডাই অক্সাইডের মাত্রা ১২ মিলিলিটারের (১২ পিপিএম) নিচে থাকলে তা মাছ ও চিংড়ির জন্য বিষাক্ত নয়। মাছের ভালো উৎপাদন পাওয়ার জন্য পুকুরের পানিতে ১ থেকে ২ পিপিএম কার্বনডাই অক্সাইড থাকা প্রয়োজন।
* ফসফরাস: প্রাকৃতিক পানিতে অল্প পরিমাণ ফসফরাস থাকে। এই ফসফরাস ফসফেটে রূপান্তরিত হয়। পরিমিত ফসফেটের উপস্থিতিতে প্রচুর পরিমাণ ফাইটোপ্লাংটন জন্মায়।
* পিএইচ: মাছ চাষের জন্য পুকুরের পানির পিএইচ ৬.৫ হতে ৮.০ এর মধ্যে হলে ভালো হয়। ৬.৫ এর নিচে পিএইচ হলে মাছের বৃদ্ধি কমে যায়। পিএইচ ৪ এর নিচে বা ১১ এর উপরে হলে মাছ মারা যায়। পানির পিএইচ কমে গেলে পুকুরে চুন (১ থেকে ২ কেজি) প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে ক্ষারীয় অবস্থা বেশি বেড়ে গেলে এমোনিয়াম সালফেট বা তেঁতুল পানিতে গুলে পুকুরে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
তথ্যসূত্রঃ আধুনিক কৃষি খামার ও ফারমস এন্ড ফারমারস