রাসায়নিক সার আর কীটনাশক ব্যবহার করতে করতে আমাদের কৃষকরা জমি ও আশেপাশের পরিবেশের যে অবস্থা যা করেছেন তাতে আর সেখান থেকে খুব সহজে ফেরার আশা নেই। রাসায়নিক সার প্রয়োগে মাটি হারিয়েছে পুষ্টি গুনাগুন, হারিয়ে গেছে উপকারী অনুজীব, পোকামাকড়, পাখি ও অন্যান্য প্রাণী। অবস্থা এখন পযায়ে গেছে যে সার ও কীটনাশক ছাড়াও ফসলের ভালো ফলন হতে পারে এটা কৃষকরা আর বিশ্বাসই করেন না। কিন্তু এসব ছাড়াই প্রায় শত বছর ধরে একই জমিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ৩৪ প্রজাতির ফসল ফলিয়ে আসছেন ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের কেরান্দিগুদা গ্রামের মানুষ। এ নিয়ে ছোট্ট একটি প্রতিবেদন পড়ুন:
লোকনাথ নাউরী এবং তাঁর ছেলে মহেন্দ্র তাদের জমিতে কোনো রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার না করেই পরম্পরাগত সাবেক চাষের পদ্ধতির মাধ্যমেই অসংখ্য প্রজাতির ফসল ফলিয়ে থাকেন।
“আমরা আমাদের মাটিতে মোটেই রাসায়নিক ব্যবহার করি না। মাটির জীবাণুগুলি জবাই করার দরকার নেই। মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকলে তা সবকিছুকেই লালন করে”, বলেন মহেন্দ্র নাউরী। নিয়মগিরি পাহাড় থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটারের দূরত্বে তার জমি। “আসলে যেটা দরকার, তা হলো জমির আলের উপর একটা মহুয়া কিংবা সহজ গাছ, যা পাখি, টিকটিকি এবং ব্যাঙেদের আশ্রয় দেবে। তারপরে এরাই ফসল ধ্বংসকারী ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড় সাবাড় করবে।”
জৈব সারের উপকারিতা
৫ হাজার বছর আগের জৈব কৃষি প্রযুক্তি
দক্ষিণ পশ্চিম ওড়িশার রায়গাডা জেলার বিশমকটক ব্লকের জনা শয়েক মানুষের গ্রাম কেরান্দিগুদায় মহেন্দ্রের দুই একর জমি আছে। এখানকার অধিকাংশ পরিবার কোন্ধ আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও নাউরী পরিবার ডোরা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।
৩০ বছর বয়সী মহেন্দ্র ও তার ৬২ বছরের পিতা লোকনাথ নিজেদের জমিতে প্রায় ৩৪টি প্রজাতির ফসল উৎপাদন করেন এবং অবিশ্বাস্য শোনালেও সব মিলিয়ে ফসলের উপপ্রজাতির সংখ্যা ৭২। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জমির বিভিন্ন অংশে তাঁরা চক্রাকারে নানান ফসল চাষ করেন। এগুলির মধ্যে আছে ক্ষুদ্র রাগি (সুয়ান, সিক্রা ইত্যাদি), ডাল (অড়হর এবং ছোলা), তেলবীজ ( যেমন তিসি, সূর্যমুখী এবং বাদাম), কন্দ (পেঁয়াজ, রসুন), হলুদ, আদা, সবুজ শাকসবজি, টমেটো, বেগুন এবং আরও নানা কিছু। “খাদ্যের জন্য আমরা বাজারের মুখাপেক্ষী নই”, বলেন মহেন্দ্র।
গ্রামবাসীরা নিয়মমগিরি পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরণার পানি ব্যবহার করেন চাষের জন্য। পাথরের বাঁধ নির্মাণ করে তারা পানির গতি ক্ষেতের দিকে চালান করেন। লোকনাথ বলেন, বিগত চার বছর যাবত এখানে জলবায়ু প্রতিকূল হলেও আমাদের ফসল এসব বিপদের মধ্যেও আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। কারও কাছ থেকে আমাকে ধার করতে হয়নি। আর এসবই সম্ভব হয়েছে আমাদের প্রথাগত চাষের পদ্ধতির কারণে।” জমি থেকে ওঠা ফসল দিয়েই পরিবারের সারা বছরের খোরাকির ব্যবস্থা হয়, এছাড়া উদ্বৃত্ত ফসল মুনিগুদা ও বিশমকটকের সাপ্তাহিক হাটে বিক্রি করেন তারা।
লোকনাথের কথায়, “আমি আজ ৫০ বছর ধরে চাষের কাজ করছি। বাবার কাছে শিখেছি কেমন করে বীজ বোনার আগে জমির মাটি তৈরি করতে হয়।” লোকনাথের পিতা ছিলেন ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক, একসময় লোকনাথের পেশাও সেটাই ছিল। তাঁর যখন ৩০ বছর বয়স, তখন সরকারের কাছ থেকে জমি পাওয়ার পর তিনি বীজ সংরক্ষণ করতে শুরু করেন।
তিনি আরও বলেন, “আমি [বাবার কাছ শেখা] ওই চাষের পদ্ধতিগুলোই অনুসরণ করে এসেছি আজ অবধি এবং তাতে ফলাফলে কোনও তফাত হয়নি। তবে আমি দেখছি বর্তমান প্রজন্মের কৃষকরা তুলো চাষ করে মাটির সর্বনাশ করছে। মাটিতে কেঁচোর অস্তিত্বই নেই! মাটি শক্ত হয়ে যাচ্ছে। এমনকি তারা বীজও বদলে ফেলছে, ধান আর শাকসবজিতে সার এবং কীটনাশক প্রয়োগ করছে। স্বভাবতই ফসলে আর আগের স্বাদ নেই। সার এবং কীটনাশকের উপর এত বেশি খরচ হচ্ছে, অথচ ফসল তেমন উঠছে না মোটেই।”
নাউরীদের কাছে জানা যায়, কেরান্দিগুদা গ্রামে তাদের পরিবারসহ আর মোটে চারটি মাত্র পরিবার চাষের কাজে রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করে না। এমনকি আদিবাসী অধ্যুষিত প্রত্যন্ত গ্রামেও এখন এগুলির চল হয়েছে। কিছু কিছু আদিবাসী পরিবার তুলা এবং ইউক্যালিপটাস চাষের জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে নিজেদের জমি ইজারা দিতে শুরু করেছে, এসব জমিতে যথেচ্ছ মাত্রায় রাসায়নিক ও আগাছানাশক ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
এছাড়াও লোকনাথ ও মহেন্দ্র ধানের আরও চারটি ঐতিহ্যবাহী প্রজাতি চাষ করেন – বহুরুপী, ভানজিবুতা, বোধানা এবং লালবোরো। লোকনাথ বলেন, প্রায় ৩০ বছর আগে এই অঞ্চলে বোধানা ধান চাষ করা হয়েছিল, বর্তমানে বহু চাষি এর বদলে অন্য ধান রোপণ করলেও তিনি এই ধান সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বল্পমেয়াদী উচ্চভূমিতে ফলা এই বিশেষ ধান বছরে তিনবার চাষ করা যায়। মহেন্দ্র নামজাদা ধান বীজ সংরক্ষক ডা. দেবল দেবের কাছ থেকে অন্য তিন প্রজাতির ধানের বীজ সংগ্রহ করেন, ২০১১ সাল থেকে কেরান্দিগুদার বাসিন্দা ডা. দেব আড়াই একর জমিতে খামার চালান। আদিবাসীদের বীজ ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত পরম্পরাবাহিত জ্ঞানকে পুনরুজ্জীবিত করতে এই অঞ্চলের জনজাতি সম্প্রদায়গুলোর সঙ্গে কাজ করে থাকেন। চাষের কাজের পাশাপাশি মহেন্দ্র বীজ সংরক্ষণের কাজে ডা. দেবের সঙ্গে মাসিক ৩০০০ টাকা সম্মানীর বিনিময়ে কাজ করেন।
মহেন্দ্র বলেন, তার বাবা লোকনাথ-ই তার পথ প্রদর্শক এবং শিক্ষক, তিনি সাবেক কৃষি-জ্ঞান ব্যবহার করে বিগত কয়েক দশক ধরে কৃষিকাজ করে চলেছেন। তার ব্যবহার্য প্রথাগত নানান কৌশলের মধ্যে আছে বুনো লতাপাতা পিষে তৈরি করা মলম যা ব্যবহার হয় গাছ এবং বীজের জন্য; বিশেষ কিছু কীটপতঙ্গ তাড়াতে এবং মাটির নাইট্রোজেন বজায় রাখতে মাঝে মাঝেই সবজি চাষ ( যেমন পেঁয়াজ), এবং রাগি চাষের ক্ষেত্রে মিশ্র চাষ (ঋতুভেদে ফসল পরিবর্তিত হয়)। মহেন্দ্র, তার ভাই এবং পাঁচ বোন সকলেই পারিবারিক জমিতে কাজ করেন। মহেন্দ্রর কথায়, “আমি আমার বাবার কাছ থেকেই কৃষিকাজ শিখেছি এবং তারপর ডা. দেব ও লিভিং ফার্মস-এর [একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যা রায়গাডা ও কালাহান্ডি জেলার আদিবাসীদের মধ্যে কৃষি ও জীবিকা বিষয়ে কাজ করে] থেকে পরাগসঞ্চার এবং ধান চারার বৃদ্ধিকে লিপিবদ্ধ করার মতো বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোতে জ্ঞান অর্জন করেছি।”
মহেন্দ্র ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ওপেন স্কুলিং থেকে পড়াশোনা করেছেন এবং বিশমকটকের মা মার্কামা কলেজ থেকে বিজ্ঞানে ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি বায়োটেকনোলজি নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের কটকের রাভেনশহ্ বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। কিন্তু পরিবারের আর্থিক দূরাবস্থার জন্য তিনি স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষা শেষ করার সুযোগ পাননি। এরপর বাবার সঙ্গে কাজ করার জন্য তিনি কেরান্ডিগুডায় ফিরে আসেন।
মহেন্দ্র তার অঞ্চলের মাটি ও উদ্ভিদ জগতের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে বদ্ধপরিকর। তিনি রাজস্ব বিভাগের একটি পতিত জমিকে রূপান্তরিত করেছেন ঘন সবুজ জঙ্গলে। তিনি ২০০১ সালে তিনি এই মাটিতেই উদ্ভিদ সংরক্ষণের কাজ শুরু করেন। তার কথায়, “দরকার ছিল শুধু সুরক্ষার, আলাদা করে গাছ পোঁতার প্রয়োজনই ছিল না। উচ্চভূমির উপর অবস্থিত এই জমিটায় আইলও ছিল না। এই ধরনের জমি সাধারণত এক বা দুই বছর ফেলে রেখে দেওয়া হয়, যাতে ক্রমশ তা ক্ষুদ্র রাগি জাতীয় শস্য চাষের উপযুক্ত হয়ে ওঠে। আমি ঠিক করেছিলাম এখানে গাছপালা বেড়ে উঠতে দেব, সেই মর্মেই এই জমির যত্ন করব। এখন আমরা [এই জমি থেকে] বুনো কন্দ, মাশরুম, সিয়ালি পাতা [এক ধরনের লতা], মহুয়া ফুল, ছার কোলি [কুল জাতীয় ফল] এবং আরও নানান ফসল সংগ্রহ করি। এই জঙ্গলের কত যে সুফল পাচ্ছি আমরা এখন”।
তথ্যসূত্রঃ কর্ষণ