প্রাকৃতিক ফল হিসাবে খুবই জনপ্রিয় এই কাজু বাদাম যা খেতে খুবই সুস্বাদু ও অত্যন্ত পুষ্টিকর। কাজু বাদামের দুটি অংশ। কাজু যাকে আপেল বলা হয় আর অন্যটি বাদাম যা দেখতে অনেকটা মানুষের কিডনির মত। আপেল সরাসরি খাওয়া যায়। বাদাম প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়ার উপযোগী করা হয়। কাজু বাদামকে ইংরেজিতে Cashew nut বলে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Anacardium occidentale । গাছ ১০-১২ মিটার উঁচু হয় এবং ৬০-৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। বাংলাদেশের পাহাড়ী এলাকায় এর চাষ সম্প্রসারণ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
জাত:
বাংলাদেশে কোন অনুমোদিত জাত নাই। তবে ফলের রংয়ের ভিত্তিতে লাল, হলুদ, গোলাপী জাত নামে বলা হয়। VLA-4, BPP-1, BPP-8, Vengurla-1, Vengurla-8, Ullal-1, BLA39-4, ভাস্করা প্রভৃতি কাজু বাদামের উন্নত হাইব্রিড জাত যা আমাদের দেশে চাষ উপযোগী।
জলবায়ু:
কাজু বাদাম উষ্ণ মন্ডলীয় ফল। কষ্ট সহিষ্ণু ও খরা প্রতিরোধী। প্রখর সূর্যালোক পছন্দ করে এবং ছায়াতে তেমন বৃদ্ধি পায়না। তাপমাত্রা অত্যধিক হলে কচি ফল ঝরে যায়। অধিক বৃষ্টিপাত এবং মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া ফলন কমিয়ে দেয়। ২০ ডিগ্রী-৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১০০০ মিমি – ২০০০মিমি কাজু বাদাম চাষে বেশ সহায়ক।
মাটি:
ভারী বেলে দো-আঁশ এবং লাল মাটির পাহাড়ী ঢালে এটি ভালো জন্মে। মাটির অম্লমান ৫-৬.৫০ গাছের বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
বংশ বিস্তার:
বীজ এবং জোড় কলমের মাধ্যমে এর বংশ বিস্তার করা যায়।
বীজ থেকে চারা তৈরি:
পাকা ফল গাছ থেকে ঝরে পড়লে সেখান থেকে বীজ সংগ্রহ করা উত্তম। এপ্রিল- মে মাসে পাকা ফলের বাদাম সংগ্রহ করে ৩-৪ দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। শুকনো বীজ ২৪-৩৬ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে অংকুরিত বীজ জুন মাসে বপন করলে অংকুরোদগম বেশী হয়।
কলমের চারা তৈরি:
জুলাই- অক্টোবর মাস পর্যন্ত কলম করা যায়। ২-৬ মাসের চারাকে আদি জোড় হিসাবে নেয়া হয়। কাঙ্খিত গাছের সায়ন ফাটল জোড় পদ্ধতিতে স্থাপন করে নতুন চারা তৈরি করা যায়।
রোপন পদ্ধতি:
জুন- আগষ্ট মাস চারা রোপনের উপযুক্ত সময়। কমবেশি ১ বছরের কলমের চারা লাগালে ভালো হয়। চর্তুভূজী পদ্ধতিতে ৭-৮ মিটার দূরত্বে রোপন করলে হেক্টরে কমবেশি ১৫০-১৮০ টি চারা প্রয়োজন। এ দূরত্বে চারা লাগালে ৩-৪ বছর আন্তঃফসল হিসাবে অন্যান্য ফসল আবাদ করা যাবে। ত্রিভুজী পদ্ধতিতে পাহাড়ীঢালে একই জায়গায় ১৫% বেশি চারা রোপন সম্ভব। ঘন পদ্ধতিতে ৪ মিটার দূরত্বে হেক্টরে ৫০০-৬০০ চারা রোপন সম্ভব। ঘন পদ্ধতিতে চারা রোপন করলে রোপনের ৩-৪ বছর হতে গাছের অংগ ছাটাই করতে হবে।
সার প্রয়োগ:
মে- জুন মাসে একবার এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের দ্বিতীয়বার গাছের গোড়ায় রিং পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। বয়স ভেদে সারের চাহিদা ভিন্ন হয়। ১ বছর বয়সী গাছের গোড়ায় ২ বারে গোবর/জৈবসার ১০ কেজি, ইউরিয়া সার ২৫০ গ্রাম, টিএসপি ২০০ গ্রাম এবং পটাশ ১৫০ গ্রাম প্রয়োজন। পরবর্তীতে ২য় বছরে ১ম বছরের দ্বিগুণ, ৩য় বছরে তিনগুণ, ৪র্থ বছরে চারগুণ এভাবে সারের মাত্রা বাড়াতে হবে। তবে কাঙ্খিত ফলনের জন্য গাছের চাহিদামত যুক্তিসংগত মাত্রায় সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
আন্তঃফসল চাষ:
৩-৪ বছর পর্যন্ত গাছের ফাঁকে পেপেঁ, আনারস, আদা, হলুদ, মুখীকচু ইত্যাদি চাষ করা যাবে।
সেচ প্রদান:
কাজু বাদামে তেমন সেচের প্রয়োজন হয়না। তবে গ্রীষ্মকালে ফল ধরার সময় একবার সেচ দিয়ে মালচিং করে দিলেই চলে।
ডালপালা ছাঁটাইকরণ:
কলমের চারার ক্ষেত্রে জোড়া লাগা স্থানের নীচে গজানো সকল ডাল কেটে ফেলতে হবে। ৩-৪ বছরের মধ্যে ডালপালা কেটে গাছের উপযুক্ত কাঠামো তৈরী করতে হবে। ৪-৫ বছর পর মাটি থেকে ৪-৫ মিটার উপরে গাছের কাণ্ড কেটে দিতে হবে। তাছাড়া ঘন, রোগাক্রান্ত মরা ডালা ছাটাই করে দিতে হবে।
টপওয়ার্কিং করা:
ফলন কমে গেছে এমন পুরানো গাছ মাটি থেকে ১-২ মিটার উঁচুতে নভেম্বর- মার্চ মাসে কেটে দিতে হবে। নতুন গজানো শাখায় ফেব্রুয়ারী -জুন মাসে উন্নত জাতের সায়ন দিয়ে জোড় কলম করে ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
বালাই দমন:
১। কাণ্ড ও মূল ছিদ্রকারী পোকা গাছের বেশ ক্ষতি করে থাকে। কার্বারাইল কীটনাশক ২ গ্রাম পরিমান ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ছিদ্রের ভিতরে স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। তাছাড়া তুলায় কেরোসিন মিশিয়ে ছিদ্রে প্রবেশ করলে এ পোকা মারা যায়।
২। চায়ের মশক গান্ধী পোকা কচি পাতা, কাণ্ড, পুষ্প মঞ্জুরী এবং কচি ফলের রস চুষে খায়। ডাইমেথয়েট/ ক্লোরোপাইরিফস ০.০৫% হারে স্প্রে করলে পোকা দমন হয়।
৩। থ্রিপস পোকা পাতার নীচের অংশ কুরে কুরে খায়। দমনের জন্য কার্বারিল/ মনোক্রোটোফস ০.০৫% হারে স্প্রে করা যায়।
৪। ফল ও বাদাম ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য মনোক্রোটোফস ০.০৫% হারে প্রয়োগ করা যায়।
৫।পাউডারী মিলডিউ/ডাইব্যাক/এনথ্রাকনোজ রোগ: রোগাক্রান্ত পাতা, ডাল, শাখা-প্রশাখা কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। ১% বর্দোমিক্সার, ডায়থেন এম- ৪৫ প্রভৃতি রোগনাশক প্রয়োগ করলে রোগের প্রকোপ কমানো যায়।
ফল সংগ্রহ ও ফলন:
বীজের গাছে ৩-৪ বছর পর এবং কলমের গাছে পরের বছর ফল ধরে। ১০ বছর গাছে পূর্ণ ফলন পাওয়া যায় এবং ২০-২৫ বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। নভেম্বর- জানুয়ারী ফুল ফোটে এবং মার্চ- মে মাসে ফল পাকে। পরিপক্ক ফল সংগ্রহ পরবর্তী বাদাম আলগা করে ৩-৪ দিন রোদে শুকিয়ে বীজে ৯-১০% আর্দ্রতা থাকে এমন অবস্থায় সংরক্ষণ করা হয়। ১০ বছর একটি গাছে গড়ে ৭-৮ কেজি বাদাম হয়। তবে হাইব্রিড জাতের গাছ ও পরিচর্যা ভাল হলে ১৫-১৬ কেজি পর্যন্ত ফলন হতে পারে।
লেখকঃ কৃষিবিদ মোঃ কবির হোসেন
পরিচালক, হর্টিকালচার উইং
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা
তথ্যসূত্রঃ আধুনিক কৃষি খামার