অভিনব ও ভিন্ন প্রজাতির মৎস্য চাষে (Different species of fish) প্রথম পশ্চিমবঙ্গ। সামুদ্রিক মাছের পুষ্টিগুণ স্বাদু বা মিষ্টি জলের মাছের তুলনায় বহুলাংশে বেশী। প্রজাতি ভেদে সামুদ্রিক মাছের স্বাদ ভিন্ন হয়, কিন্তু পুষ্টিগুণ বিচারে সব সামুদ্রিক মাছই অনন্য। সামুদ্রিক মাছের বেশ কয়েকটি গুণাগুণ রয়েছে, যেমন, হৃদরোগ প্রতিরোধ, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি, কলেস্টোরল ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে এবং সামুদ্রিক মাছে রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খনিজ উপাদান ‘সেলেনিয়াম’, যা প্রধানত মিষ্টি জলের মাছে অনুপস্থিত থাকে। এই উপাদানটি বিপাকক্রমে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে।
পূর্ব ভারতের অধিকাংশ মানুষের পছন্দের তালিকায় সর্বদাই মিষ্টি জলের মাছ। কিন্তু এই প্রবণতা দক্ষিণ ভারতীয় উপকূলবর্তী মানুষের ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায় না। তথাপি উপরিউক্ত উপকারিতাগুলির নিরিখে সহজেই বলা চলে, সাপ্তাহিক খাদ্যতালিকায় অন্ততপক্ষে একদিন সামুদ্রিক মাছ থাকা জরুরী।
সিলভার পম্পানো (Trachinotus blochii) –
যে সকল সামুদ্রিক ফিনফিশের ভারতে চাষের সম্ভবনা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম সিলভার পম্পানো বা florida পম্পানো। মাছটি যেমন দ্রুত বৃদ্ধি পায়, তেমনই মাংসের গুণগত মানের দিক থেকেও তা অত্যন্ত সুস্বাদু ও পাশাপাশি রপ্তানি বাজারেও বিশেষ চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। বাণিজ্যিক মৎস্যচারণে মাছটি বিক্ষিপ্তভাবে ধরা পড়ে, সেই কারণে জলজ চাষই বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে চাহিদা পূরণের একমাত্র উপায়। সমুদ্রে ভাসমান খাঁচা, ট্যাঙ্ক ও পশ্চিমবঙ্গে পুকুরেও এই মাছটি চাষের ক্ষেত্রে সফলতা মিলেছে।
মাছটির বৈশিষ্ট্য –
পমফ্লেট মাছের নতুন প্রজাতি ‘সিলভার পম্পানো’, উষ্ম গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফিনফিশ।
মাছটি পেলাজিক প্রকৃতির।
অত্যন্ত সক্রিয় ও দ্রুত বর্ধনশীল ‘carangidae’ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
পরিবেশে সহনশীলতা অত্যন্ত বেশী, প্রায় ৮ ppt কম লবণাক্ততায়ও মাছটির বৃদ্ধি কোনভাবে বাঁধাপ্রাপ্ত হয় না।
মাছগুলি দৈর্ঘ্যে ১.২ মিটার (৩.৯ ফুট) ও অজনে ৮ কেজি পর্যন্ত সর্বাধিক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
খুব অল্প সময়েই বিক্রয়যোগ্য আয়তনে চলে আসে (৪-৫ মাসের মধ্যে)।
চিংড়ি চাষের পরবর্তী যে সময়কালে চাষবর্তী পুকুরগুলি পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে, সেই অন্তর্বর্তী সময়ে পুকুরগুলি পম্পানো চাষে বিশেষ উপযোগী। কারণ, পম্পানো চাষের ফলে চিংড়িতে সংক্রমণকারী হোস্ট জাতীয় ভাইরাসের জীবনচক্র ভেঙে যায়, যা চিংড়ির জীবনকালীন মেয়াদ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
রাজ্যে মাছটির অবস্থান – রাজ্য মৎস্যকেন্দ্রগুলির সহযোগিতায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার সমুদ্র লাগোয়া অঞ্চলে পুকুর খনন করে উন্নতমানের বায়ুসঞ্চালক যন্ত্রের সাহায্যে, তাতে সমুদ্রের নোনাজল ভরে তামিলনাড়ুর মান্দাপাম থেকে সংগৃহীত সিলভার পম্পানোর চারা দ্বারা মৎস্যচাষের প্রকল্পটি শুরু করা হয়েছিল। বর্তমানে পমফ্লেট-এর বিকল্প ‘সিলভার পম্পানো’ মাছের এই বঙ্গীয় পদ্ধতি সারা ভারতে ‘আদর্শ বা মডেল’ হিসাবে নির্ধারিত হয়েছে। চাষের জন্য নির্ধারিত পুকুরের গভীরতা ১.৫ মিটার ও জলে লবণাক্ততার পরিমাণ ১৫-২৫ ppt রাখা হয়। প্রথম প্রকল্পটিতে সাফল্য মেলার পর বহু মৎস্যজীবী ‘রৌপলী পম্পানো’ চাষে উতসাহ প্রকাশ করেন এবং বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ বীজ উৎপাদন থেকে ব্রুডস্টক ম্যানেজমেন্ট উভয় ক্ষেত্রেই সফলতা পেয়েছে।
কোবিয়া (Rachycentron canadum) –
Rachycentron গ্রুপের একমাত্র নমুনা স্বরূপ সামুদ্রিক মাছ কোবিয়া। মাছটি দ্রুত বৃদ্ধি ও মাংসের গুনগত মানের কারণে জলজ চাষে অন্যতম সম্ভাব্য প্রজাতি হিসাবে বিবেচিত।
সাধারণ নাম – কোবিয়ার পাশাপাশি মাছটি ব্ল্যাক কিংফিশ, ব্ল্যাক স্যালমন, লেমন ফিশ, ক্র্যাব ইটার, সার্জেন্ট ফিশ নামেও পরিচিত।
মাছটির বৈশিষ্ট্য –
দীর্ঘ আকৃতির এই মাছটির মুখ পয়েন্টযুক্ত এবং দেহ মসৃণ, খুব ছোট স্কেল স্বারা আচ্ছাদিত।
শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক শিকারী স্বভাব এই শ্রেণীর মাছের মধ্যে দেখা যায়।
মাছগুলি দৈর্ঘ্যে ৬ ফুট ও ওজনে ১৫০ পাউন্ড (৭০ কেজি) পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে এবং প্রায় ১২ বছর বেঁচে থাকে।
পৃষ্ঠপাখনা দ্বারা মাছটিকে খুব সহজেই শনাক্ত করা যায়।
কোবিয়া একটি দুর্দান্ত বিনোদনমূলক মাছ বা গেম ফিশ হিসাবেও বিবেচিত।
মাছগুলি আগ্রাসী প্রকৃতির হওয়ায় জলজ চাষে এদের অন্য কোন মাছের সাথে রাখা যায় না।
প্রধানত ছোট মাছ, স্কুইড, কাস্ট্রেসিয়ান প্রভৃতি খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। এই মাছগুলির অন্যতম প্রিয় খাদ্য ‘কাঁকড়া’, ‘ক্র্যাব ইটার’ নামেও পরিচিত।
রাজ্যে মাছটির অবস্থান – রাজ্য মৎস্য গবেষণাকেন্দ্রগুলির উদ্যোগে দীঘার তাজপুর সমুদ্র সৈকতের কাছে আলমপুরে ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার হেনরি আইল্যান্ডে পুকুর খনন করে স্লুইস গেটের মাধ্যমে, যাতে সমুদ্রের নোনা জল জোয়ারের সময় পুকুরে প্রবেশ করতে পারে, এই পদ্ধতির মাধ্যমে চাষ শুরু হয়। কোবিয়া দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় অল্প সময়ে (৪-৫) মাসে বিক্রয়যোগ্য আয়তনে চলে আসে, যার ফলে মৎস্যজীবীদের খরচ খানিক্টা গ্রাস পায়। নিগম সূত্র মারফৎ জানা যায়, দিল্লী খাদ্যমেলার পশ্চিমবঙ্গ স্টলে ঠাঁই পেয়েছে কোবিয়ার রকমারী পদ। শীতকালে আয়োজিত নিউটাউন উৎসবে শুধু কোবিয়ার পদ বিক্রি হয়েছে ৪ লক্ষ টাকার ও শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় ১ লক্ষ ৮৪ হাজার টাকার। এই পদগুলির মধ্যে ছিল “রোস্টেড ক্রিম কোবিয়া, কোবিয়া মালাই, গ্রীলড কোবিয়া, বেকড কোবিয়া ও কোবিয়ার পাতুরী”।
অরেঞ্জ স্পটেড গ্রুপার (Epinephelus coioides) –
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিকভাবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক মাছ ‘গ্রুপার’, যা Epinephelus বর্গের অন্তর্ভুক্ত। ফিলিপাইনে মাছটি ‘lapu lapu’ নামেও পরিচিত।
মাছটির বৈশিষ্ট্য –
গ্রুপার দৃঢ় দেহ সম্পন্ন মাংসাশী প্রকৃতির মাছ।
শরীর দীর্ঘায়িত এবং দু সারিতে নিম্ন চোয়ালের মাঝখানে দাঁত উপস্থিত।
সর্বোচ্চ ৩২ কেজি পর্যন্ত ওজনে ও দৈর্ঘ্যে ১২০ সেমি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
এরা মূলত অমেরুদণ্ডী প্রাণী অক্টোপাস এবং কাস্টেসিয়ানকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে।
বিশ্বজুড়ে এই মাছগুলি পাথুরে ও প্রবাল প্রাচীর সংলগ্ন স্থানগুলিতে পাওয়া যায়।
গ্রুপার সাধারণত protogynous বা উভলিঙ্গ বলে মনে করা হয়। যৌন পরিপক্কতার আগে পর্যন্ত সব মাছগুলি স্ত্রী মাছ হিসাবে থাকে এবং যৌন পরিপক্কতা সম্পূর্ণ হওয়ার পর বেশ কিছু মাছ পুরুষ মাছে রূপান্তরিত হয়।
রাজ্যে মাছটির অবস্থান – ভারতীয় মৎস্যচাষীদের হ্যাচারীতে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে দেখা গেছে এই মাছটিকে। আমাদের রাজ্যও সেখানে কোন অংশে পিছিয়ে নেই। ফেজারগঞ্জে হ্যাচারীতে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ আরম্ভ হয় এবং সময়ের সাথে সাথে সাফল্য মেলার পর রাজ্য মৎস্যচাষীদের মাধ্যমে বর্তমানে বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে। শীতের সময়ে আমাদের রাজ্যে ভেটকি মাছের বিশেষ চাহিদা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী, যোগান সম্ভব হয় না। কারণ, ভেটকির চাষ বেশ ব্যয়বহুল। এই সমস্যার কথা মাথায় রেখে বিকল্প নতুন প্রজাতির মাছ চাষ শুরু করা হয়। স্বাদের দিক থেকে গ্রুপার ভেটকির চেয়েও ভালো এবং দামও ভেটকির তুলনায় অনেকটা কম।এই পুষ্টি উপাদানগুলি ছাড়াও তিনটি মাছেই আয়োডিন, সেলেনিয়াম, জিংক এবং পটাশিয়াম সহ দশটি অপরিহার্য অ্যামাইনো অ্যাসিড পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান থাকে।
এই নতুন প্রজাতির সামুদ্রিক মৎস্যচাষের বঙ্গীয় পদ্ধতি শিখতে পশ্চিমবঙ্গের দ্বারস্থ হয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ। শুধু অন্ধ্র নয়, তার সাথে গুজরাট, মহারাষ্ট্রও। উপকূলীয় এই মাছগুলির রপ্তানি মূল্য খুবই ভালো। কারণ, বিদেশীরা কাঁটাযুক্ত মাছ খেতে বিশেষ স্বাছন্দ্যবোধ করেন না। তাই সঠিকভাবে পরীক্ষামূলক পদ্ধতিতে সামুদ্রিক মৎস্যচাষের বিকাশ ঘটালে, এর উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণন সংস্থা গড়ে উঠবে বলে বহু মানুষ নতুন আয়ের উৎস খুঁজে পাবেন। আবার, একদিকে যেমন স্বাদের দিক থেকে ভারতীয় মাছের বাজারগুলিতে ভিন্ন বৈচিত্র্যের মাছের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, তেমন অন্যদিকে সামুদ্রিক মাছ অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হওয়ায় তা মানবজীবনে সুস্বাস্থ্য নিরাপত্তার দিকটিও নিশ্চিত করবে। সুতরাং, সামুদ্রিক মৎস্যচাষের বিকাশ কেবলমাত্র মৎস্যজাত সম্পদ বৃদ্ধি করবে না, এর পাশাপাশি বহু মানুষকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভরকরণের মাধ্যমে রাজ্য তথা দেশের অর্থনীতির চাকাও দৃঢ় করতে দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা রাখবে।
তথ্যসূত্রঃ কৃষি জাগরণ