ভাসমান বাশের খাঁচায় কাকড়া পালন

আধুনিক উপায়ে কাঁকড়া চাষ করে মাসে অর্ধ লক্ষ টাকা উপার্জন সম্ভব, জানুন কিভাবে?

বর্তমানে কাঁকড়া চাষ অনেক লাভজনক এইটি প্রকল্প। ভাসমান বাঁশের খাচায় কাকড়া পালন। বিদেশী দাতা সংস্থা ডি. এফ. আই. ডি. এর সুপার সার্পোট ফর ফিসারিজ এডুকেশন এন্ড রিচার্স প্রকল্পের আর্থিক সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইনিষ্টিটিউটের অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ জাফর গত বছরের গোড়ার দিকে কক্সবাজারের চকরিয়া, সুন্দরবন, রাম পালের ভাগাই এবং সাতক্ষীরায় মুন্সি গঞ্জের উপকূলীয় দরীদ্র জন গোষ্ঠির অংশ গ্রহনের মাধ্যমে কাকড়া চাষের সম্ভাব্যতা পরীক্ষণ নামে এক গবেষনা কার্যক্রম শুরু করেছিলেন।

ভাসমান বাশের খাঁচায় কাকড়া পালন তার সেই গবেষনা কার্যক্রমে সাফল্য মিলেছিল সাংঘাতিক। সেখানকার গরীব চাষীদের ও ভাগ্যের দুয়ার গিয়েছিল খুলে। জীবন নকশায় আজ জানা যাক, সেই সকল প্রযুক্তির বিষয়।

কাকড়া চাষঃ

বাংলাদেশের উপকুলিয় অঞ্চল ও প্লাবন (মেনগ্রভ) সংলগ্ন এলাকা জাতি কাকড়া চাষের জন্য উপযোগী। আলোচ্য পদ্ধতিতে বাশের বন্ধ খাঁচাতে কাকড়ার পরিচর্যা বা খাবার দেয়ার কাজটা নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। মলটিন বা খোলস বদলানোর সময় একে অপরকে খাওয়ার প্রবণতা থাকে না বলে বাঁচার হার বেড়ে যায়। এ পদ্ধতিতে নদী বা মোহনায় খাঁচা বসিয়ে কাকড়া পালন করা হয় বলে কাকড়ারা প্রকৃতিক পরিবেশেই তারাতারি বেড়ে ওঠে।

কিভাবে তৈরি হবে খাঁচাঃ

প্রথমেই লাগবে বাঁশ। সঙ্গে লাগবে প্লাষ্টিক ড্রাম আর সুতা। খাঁচার আয়তন অনুযায়ি এক বা ১.৫ সেঃ মিঃ মোটা করে ফালি করতে হবে বাঁশ। এর পর এগুলোকে শক্ত চিকন সুতা দিয়ে পাশা পাশি গেথে বানা তৈরি করতে হবে। বানাগুলোকে এবার খাঁচার আকৃতি (দৈর্ঘ  প্রস্থ  উচ্চতা) বুঝে পাশা পাশি সংযুক্ত করে বানাতে হবে খাঁচা। খাঁচাটা (৭৩১) ফুট আকৃতির হলেই সবচেয়ে ভাল হয়। এতে থাকবে ৬০টি প্রকোষ্ঠ। প্রত্যেক প্রকোষ্ঠের আয়তন (৭৭১০ ) ইঞ্চি করে হবে। উপরের ঢাকনাটাও এমন বাধতে হবে যেন খাবার দেয়া পরিচর্যা আর স্থানান্তর সুবিধা হয়।

পানিতে খাঁচা বসানোঃ

পানিতে খাঁচা বসানোর ক্ষেত্রে জোয়ার ভাটা ভাল মত হয় এ রকম চ্যানেল বা মোহনায় লোনা পানির বাছতে হবে। খাঁচাটাও বসাতে হবে এমন করে যেন ভাটার সময় নদীর তলায় লেগে না যায়। খাঁচার উপরের চার কোনায় চারটি প্লাষ্টিকের ছোট ড্রাম বেধে দিতে হবে। যাতে এক/ দের ইঞ্চি ভাসিয়ে রাখতে পারে খাঁচাটাকে। নদীর তলদেশে শক্ত খুটি পুতে তার সঙ্গে সর্বোচ্চ জোয়ারের উচ্চতা মাথায় রেখে খাঁচাটাকে বেধে দিতে হবে। মজবুত রশি দিয়ে। তাতে জোয়ার ভাটায় উঠা নামা করবে খাচাটা।

কাকড়া মজুদঃ

১৮০/২০০ গ্রাম ওজনের নরম খোলস আর গোরাল অপরিপক্ক এমন কাকড়াই মজুদ করতে হবে। কাজটা অভিজ্ঞ চাষির পরামর্শ নিয়ে করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বছরের যে কোন সময়ে কাকড়া মজুদ করা যায়, তবে বর্ষাকালটাই সবচেয়ে ভাল। আহত বা পা নেই এমন কাকড়া মজুদ করাটা ঠিক হবে না।

খাবারই এক মাত্র পরিচর্যাঃ

রোজ সকাল আর বিকেলে কাকড়া দেহের ওজনের ৫% পরিমান খাবার দিতে হবে। কুইচ্যা (ইলমাছ) তেলাপিয়া, ছোট মাছ, হাঙ্গরের মাংস, চিংড়ির মাথা ছোট ছোট টুকরা করে দেয়া যেতে পারে খাঁচার এক একটি প্রকোষ্ঠে। এই খাবার দেয়া ছাড়া বাড়তি কোন পরিচর্যার দরকার নাই কাকড়ার। সবকিছু ঠিক ঠাক থাকলে দুই বা তিন সপ্তাহের মধ্যেই কাকড়াগুলো বাজারজাত করা উপযোগী হয়ে যাবে। পুরো খাঁচা তুলে এনে চিমটা দিয়ে কাকড়া ধরতে হবে। খুব সাবধানে। কোন অঙ্গ প্রতঙ্গ নষ্ট হয়ে গেলে এর কিন্তু কেন দাম কম বাজারে। ধরার সঙ্গ সঙ্গে পা বেধে ফেলতে হবে রশি দিয়ে।

এ পদ্ধতির সুবিধাঃ

ভাসমান বাশেঁর খাচায় কাকড়া পালন সহজ, কম ঝুকিপূর্ণ, স্থানান্তর যোগ্য, পরিবেশ অনুকুল আর লাভজনকও। তেমন বিনিয়োগ করতে হয় না বলে বিনা পুজিতেই অনেক লাভ করতে পারে গরিব কৃষকরা। আরো সুবিধা হচ্ছে- কাকড়ার মৃত্যুর হারও এখানে কম, রোগ সংক্রমনের ভয়ও নাই। আবার মাটি ও পানিও দুষিত হয় না। তাছাড়া অল্প জায়গায় অনেক বেশি কাকড়াও পালনকরা যায়।

খরচা পাতিঃ

ভাসমান বাশেঁর খাচায় কাকড়া চাষ করেছিলেন যে চাষিরা, তাদের কাছ থেকেই জানা গেল বাশের খাঁচা, বাশ, সুতা, কাঠ, প্লাষ্টিক ড্রাম কেনা বাবদ ১৫০০ টাকা এবং শ্রম মূল্য ১৫০০ টাকা করে ৩০০০ টাকা খরচ হবে প্রথমে এবং এক বারই। এর পর প্রতিবার কাকড়া পালনে খরচটা হবে এভাবে; ১ কেজি ২০০গ্রাম কাকড়ার দাম ২৫ টাকা হিসেবে ৬০টি বা ১১ কেজি কাকড়া কিনতে খরচ হবে ২৭৫ টাকা। ১৫ দিনের খাবার খরচ ২০০ টাকা , আর ১৫ দিনে মোট ৩০ ঘন্টার শ্রমিক খরচ ৪০০ টাকা। এক বছরে ২০ বার এক খাঁচায় চাষ করা যাবে, এ জন্য প্রতি মাসে কাকড়া পালনের জন্য খাচা বাবদ খরচ ১৫০ টাকা।

অতএব প্রতি বার বেকারত্ব মোচনে কাকড়া পালনে মোট বিনিয়োগ খরচ ১০২৫ টাকা। ১৫ দিন পালনের পর ১৮০ বা ২০০ গ্রাম ওজনের এক একটি কাকড়ার ওজন হবে প্রায় ২৫০ গ্রাম এবং গড়ে ৫০টি কাকড়া বেচে থাকবে। এতে মোট ওজন হবে(২৫০৫২= ১২৫০০) গ্রাম বা ১২.৫ কেজি। এক কেজি কাকড়ার বিক্রয় মূল্য ২০০ টাকা হলে মোট আয় হবে। (২০০১২.৫=২৫০০) টাকা। অর্থাৎ ১৫ দিনে আসলে লাভ হচ্ছে (২৫০০-১০২৫=১৪৭৫) টাকা। প্রতি দুই মাসে একটা খাঁচা থেকে কম পক্ষে তিনটি ফলনে আয় হবে। (১৪৭৫৩=৪৪২৫) টাকা। এক সঙ্গে সাধারনত চারটা খাাঁচয় কাকড়া পালন করা হয়। সেক্ষেত্রে দুই মাসে আয় হবে। (৪৪২৫৪=১৭৭০০) মাসিক আয় সে ক্ষেত্রে দাড়াচ্ছে প্রায় ৯০০০ হাজার টাকার মত।

অনুকুল পরিবেশ, সহজলভ্যতা, স্থানীয় ও বিদেশী বাজারে চাহিদা, উচ্চ পুষ্টি গুণ, স্বল্প মূল্যের খাদ্যপ্রাপ্তি, দরীদ্র জনগোষ্টির আগ্রহ এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা মিলে বাংলা দেশের কাকড়ার চাষের বিরাট ক্ষেত্র রয়েছে। ।

তথ্যসূত্রঃ কৃষি সংবাদ