গাজর চাষ করে স্বাবলম্বী হতে পারেন আপনিও, জানুন এর চাষ প্রণালী সম্পর্কে

এক সময় শীতকালীন সবজি হিসাবে পরিচিত গাজর এখন সারা বছরই বাজারে পাওয়া যায়। আর এর বাজার মূল্যও অনেক ভাল। গাজর চাষ করে অনেকেই সাফল্য পেয়েছে, আপনিও পেতে পারেন। শীতকালীন সবজিগুলোর মধ্যে গাজর একটি অন্যতম সবজি। এটি মুখরোচক শীতকালীন সবজি। ইংরেজি নাম Carrot ও বৈজ্ঞানিক নাম Daucus carota. এ ফসলটি সারা বছর হলেও অন্য সময়ের তুলনায় শীতে বেশি ফলন দেয়। দেশের প্রায় সব জায়গায় গাজর চাষ করা হয়। তবে আমাদের দেশে যশোর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদি, পাবনা প্রভৃতি জেলায় গাজর উৎপাদন বেশি হয়।

গাজর চাষ/মাটির প্রকৃতি ও জলবায়ু:

গাজর চাষের জন্য গভীর দো-আঁশ বা বেলে দোঁআশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। সাধারণত গাজর চাষের জন্য আশ্বিন থেকে কার্তিক অর্থাৎ মধ্য সেপ্টেম্বর মধ্য নভেম্বর মাস বীজ বপনের উত্তম সময়। ঠান্ডা আবহাওয়ায় গাজর ভালো জন্মে এবং চাষের জন্য উঁচু রোদযুক্ত জমি নির্বাচন করা ভাল।

গাজরের জাত:

আমাদের দেশে সাধারণত দুই ধরণের গাজর চাষ করা হয়ে থাকে। একটি হল গ্রীষ্মকালীন এবং অপরটি নাতিশীতোষ্ণ। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জাত তুলে ধরা হল যেমন:- কুয়োদা নিউ, কুয়োদা চেনটিনি, চেনটিনি রেডকোর, কিনাকো ক্রস এফ-১, সানটিনি, রয়েল ক্রস ইত্যাদি।

জমি প্রস্তুতকরণ:

১. গাজর চাষের জমি ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি গভীর করে চাষ দিতে হবে। কারণ গাজরের শেকড় মাটির বেশ ভেতরে প্রবেশ করে।

২. গাজর চাষ করার জন্য জমি ৪ থেকে ৫টি চাষ দিতে হবে এবং মই দিয়ে জমি ভালোভাবে তৈরি করতে হবে।

৩. চাষকৃত জমির ঢেলা ভেঙ্গে মাটি ঝরঝরে করতে হবে।

৪.গাজরের বীজ সারিতে বপন করা ভাল তাই জমিতে ৮-১০ ইঞ্চি দূরে দূরে সারি তৈরি করতে হবে।

বীজ বপন পদ্ধতি:

১. জমিতে বীজ বপনের আগে গাজরের বীজ একদিন ভিজিয়ে রাখতে হবে।

২. গাজরের বীজ আকারে খুব ছোট হয়। এজন্য বীজ বপনের সময় বীজের সাথে ছাই বা মাটি গুঁড়া মিশিয়ে নিতে হবে।

৩. সারিতে বীজ বপণ করলে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি দূরে দূরে বীজ বপন করতে হবে।

উল্লেখ্য যে, একরে বীজ লাগবে দেড় থেকে ২ কেজি এবং বীজ বোনার ৮০-৯০ দিনের মধ্যে প্রথম ফসল ওঠে।

সার ব্যবস্থাপনা:

গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে গাজর চাষের জমিতে যত সম্ভব বেশি বেশি জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুযায়ী জমিতে সার প্রয়োগ করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়। হেক্টরপ্রতি গাজর চাষে নিম্নরূপ হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।

সার সারের পরিমাণ(প্রতিহেক্টরে)
গোবর/জৈবসার ১০ টন

ইউরিয়া ১৫০ কেজি
টিএসপি ১২৫ কেজি
এমপি/এসওপি ২০০ কেজি

উল্লেখ্য যে, জমি তৈরির সময় সম্পূর্ণ গোবর ও টিএসপি এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে।বাকি অর্ধেক ইউরিয়া চারা গজানোর ১০-১২দিন ও ৩৫-৪০ দিন পর সমান দুই কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। অনুরুপভাবে বাকি অর্ধেক এমপি সার গজানোর ৩৫-৪০ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

পরিচর্যা:

বীজ বপনের পর গাজরের ক্ষেতে একটা হালকা করে সেচ দিতে হবে। সেচের পর জমিতে জো এলে নিড়ানি দিয়ে চটা ভেঙ্গে মাটি আলগা করে দিতে হবে। চারা বের হতে শুরু করলে আরেকটি সেচ দিলে বীজের অঙ্কুরোদগম ভালো হবে। মনে রাখতে হবে ফসল তোলার সময় প্রয়োজনে আর একবার সেচ দিতে হবে। জমিতে পানি জমলে ফসলের ক্ষতি হয় তাই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং আগাছা জন্মালে দমন করতে হবে।

পোকামাকড় ও রোগ বালাই:

পচারোগ: গাজর চাষে প্রায়শ এ রোগের প্রার্দুভাব লক্ষণীয়। গাজরের মূল ও পাতার গোড়ায় ব্যাক্টেরিয়াজনিত পচন রোগ দেখা যায়। উল্লেখ্য যে, নাইট্রোজেন সার অতিরিক্ত প্রয়োগে এ রোগ বেড়ে যায়।

গাজরের হলুদ ভাইরাস রোগ: অন্যান্য ফসলের তুলনায় গাজরে খুব একটা রোগ বালাই ও পোকামাকড় দেখা যায় না। তবে লীফ হপার পোকার মাধ্যমে গাজরে অনেক সময় হলুদ ভাইরাস রোগ প্রার্দুভাব দেখা যায়। এ পোকার আক্রমণের ফলে গাজরের ছোট বা কচি পাতাগুলো হলুদ হয় পরে কুঁকড়িয়ে যায় এবং লক্ষণীয়ভাবে গাছের পাতার পাশের ডগাগুলো হলুদ ও বিবর্ণ হয়ে যায়।

জাবপোকা: গাজর চাষে জাব পোকা একটি বিরাট অন্তরায়। এই পোকা গাছের পাতা ও কচি অংশের রস চুষে খেয়ে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করে।

প্রতিকার:

গাজরের পোকামাকড় ও রোগ বালাই দমনে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা উত্তম। জৈব কীটনাশক ব্যবহারে পোকা দমন না হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে।

ফসল সংগ্রহ:

জমিতে চারা গজানোর ৭০-৮০ দিন পর মুলত গাজর সবজি হিসেবে খাওয়ার উপযোগী হয়। তবে পুষ্ট ও ভালোমানের গাজর পেতে হলে জমিতে বীজ বোনার ১০০ থেকে ১২৫ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করতে হবে।

ভিটামিন:

গাজরে মধ্যে অনেক ধরণের খাদ্যগুন বিদ্যমান রয়েছে। প্রচুর পরিমানে ক্যারোটিন, ভিটামিন ‘এ’, থায়ামিন ও রিবোফ্লোবিন সমৃদ্ধ এ সবজি। গাজরের সবুজ পাতা ও পুষ্টিকর, প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ। এছাড়া গাজরে যথেষ্ট পরিমাণ ক্যালসিয়াম,ফসফরাস, লৌহ, কার্বহাইড্রেট বা শর্করা পাওয়া যায়।

গাজরের বিবিধ ব্যবহার:

গাজর কাঁচা অবস্থায় গাজর খাওয়া যায় এছাড়া রান্না করে, সালাদ তৈরিতে ও গাজর প্রচুর ব্যবহৃত হয়ে থাকে।কালোরঙা গাজর দিয়ে এক রকম সুধাবর্ধক পানীয় তৈরি হয়। এছাড়া বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার যেমন হালুয়া, পায়েস ইত্যাদি তৈরিতে গাজর ব্যবহৃত হয়ে থাকে। লক্ষণীয় যে, ছোট বড় সকলেই গাজর খুবই পছন্দ করে তাই এর চাহিদা প্রচুর।

তথ্যসূত্রঃ সফল খামারী